বঙ্গে বিলাতি ভূত
যাদবপুরের ৮বির কাছে সদ্য সিগারেটে আগুনটা দিয়েছি, পিছনে
একটা টোকা।
দেখি এক ছুঁচলো দাড়িওয়ালা সাহেব। বেশি লম্বা নন, মাথায়
টাক। আমি বললাম, "কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে?"
তিনি মুচকি হেসে বললেন, "ওই তো, ওইখানে। স্ট্যাচু দেখেছেন। মাঝে মাঝে জেগে
উঠি আর কি, সারাক্ষণ স্ট্যাচু হয়ে থাকতে কি ভালো লাগে।"
আমি এবার চিনতে পারলাম। বললাম, "আরে লেনিনদা। চিনতেই পারিনি।"
লেনিনদা কে খুব চিন্তিত লাগছিলো। আমি বললাম, "কি এত ভাবছেন?"
লেনিনদা বললেন, "বুর্জোয়াদের সাথে কি করে লড়তে হবে তাই
নিয়ে তো আমি বিস্তর লিখেছি, কিন্তু ফিল্মস্টার দের সাথে কম্যুনিস্টরা
কি করে লড়তে পারে সেটা তো ভাবা হয় নি। মার্ক্সও কিছু লেখেন নি।"
আমি বললাম, "এটা ক্যাপিটালের কোন রূপ বলে মনে হচ্ছে?" সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
"এ বড় কঠিন প্রশ্ন, ভাবতে
হবে।" বলেই তিনি আবার স্ট্যাচু হয়ে গেলেন।
২
কফি হাউসে সবে চিকেন আফ্গানী এক টুকরো মুখে দিয়েছি, পিছন
থেকে কার একটা গলা - "নলেজ আর পাওয়ারের সম্পর্কটা বোঝা হল?"
আমি মুখ ঘুরিয়ে দেখি এক টেকো সাহেব। দু' সেকেন্ড
লাগলো চিনতে। বললাম, "আরে ফুকোদা, কবে এলেন, কী নেবেন বলুন, ইনফিউসন?"
ফুকোদা চেয়ারটা টেনে বসে বললেন, "না ভাই, তোমাদের দেশে আমি কফি খেতে পারবো না। যাই হোক, যেটা
বলছিলাম - ক্লাস এনিমি দেখতে পাচ্ছো?"
আমি বুঝলাম যে টেকো জ্বালিয়ে খাবে এবার। আমি আরেক টুকরো
আফগানী মুখে দিয়ে বললাম, "তা জোতদার-জমিদার তো অনেকদিন আগেই কেটে
পড়েছে।"
টেকো সাহেবের মুখে মৃদু হাসি,
"আর বুর্জোয়া?" আমি বললাম, "স্যার, বুর্জোয়ারা তো রাজ্যে শীতকালে আসে মদ
খেতে।"
ফুকোদা হেসে বললেন - "তাহলে, শত্রু কোথায়?
দেখতে পাচ্ছো?" বললাম,
"আমার তো কোনো শত্রু নেই।"
ফুকোদা দাঁত কিরমির করে বললেন, “সহায়িকা
গ্রন্থ পড়ে পাশ করেছো মনে হচ্ছে। কি যে হবে তোমাদের।”
৩
পার্ক স্ট্রীটে একটু ঢুকু ঢুকু করে নিয়ে বেড়োতে যাবো, এক
বিটকেল দেখতে সাহেব এসে বসলেন সামনে।
লম্বা নাক, আবার মাথায় একটা পরচুলা। বললেন, "চিনতে পারছো?" আমি বললাম, "কোথাও একটা দেখেছি আপনাকে। মনে নেই।"
তিনি অভিমান করে বললেন, "তা আর থাকবে কেন, তোমরা
তো দেড়েল মার্কসকেই ভালবাসলে। তা অ্যাডাম স্মিথ নামটা মনে পড়ে কি?"
আমি তরাক করে লাফিয়ে উঠে বললাম, "আরি বস, চোতা বইতে পড়েছি তোমার নাম - ফাদার অফ ক্যাপিটালিজম।"
তিনি চোখের জল মুছে বললেন,
"আমার সব থিওরি ফেল
করে গেছে বুঝলে, তোমাদের জন্য।"
আমি বললাম, "কেমন করে? আমাদের কি দোষ?" তিনি আবার চোখ মুছে বললেন, "যাও বা মার্কসের চ্যালারা আমার প্রতি একটু
দুর্বলতা বশত ক্যাপিটালিজম এর প্রতি ঝুঁকেছিল, তাও পন্ড হয়ে গেলো। আচ্ছা তোমরা ক্যাপিটালিস্ট
হতে চাওনা কেন বল তো?"
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম "স্যার এই প্রশ্নটা সাজেসানে ছিলো
না। এখন কাটি।"
৪
ময়দান দিয়ে ট্রাম চলেছে টুক টুক করে। প্রায় ফাঁকা। আমি
বাদাম খাচ্ছি।
পাশের সিটটা খালি ছিলো। ট্রামটা থামতেই দেখলাম এক মেমসাহেব
উঠলো। আরিস্যালা, কি কপাল মাইরি, ঠিক
আমার পাশেই এসে বসলো। জীবনে প্রথমবার মেমসাহেবের পাশে বসার অভিজ্ঞতা।
আমি একটু হাসতেই দেখলাম সে গল্প করতে শুরু করে দিলো। আমি
জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কী করেন?” মিষ্টি হেসে মেম বলল– “আমি লিখি। একটা বই
এক কালে বেশ নাম করেছিলো– দি সেকেন্ড সেক্স।” আমি তো নাম শুনেই ঘাবড়ে গেলাম। পানু
লেখিকা, লে
হালুয়া। মেম বললেন, “পড়েছো?”
আমি একটু কেত মেরে বললাম, “আজকাল তো
সব নেটেই পাওয়া যায়, কেউ বইয়ে আর ওগুলো পড়ে না”। উনি বললেন,
“কোনগুলো?” আমি
মুচকি হেসে বললাম, “ওই সেক্স-টেক্স।”
মেমসাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “ইউ আর সো
সুইট। বাই দ্য ওয়ে, আমি সিমোন, সিমোন দে
বুভুয়া”। আমিও বললাম, “আমি ঝন্টু, ঝন্টু দাশ”।
সিমোন বললেন, “তা ঝন্টু, প্যাট্রিয়ার্কি
ব্যাপারটা বোঝো তো?”
আমি ভাবলাম মেমসাহেবের কাছে আর লজ্জা কি, বললাম, “প্রেসি’র একটা মেয়েকে ছক করতে চেষ্টা করছিলাম, সে ওই শব্দটা
খুব বলতো। আমি অবশ্য বিশেষ সুবিধা করতে পারি নি, পাত্তা
পাইনি আর কি”। সিমোন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইস, আমি
বুঝিয়ে দেবো, এর পর আর
অসুবিধা হবে না। তা মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কম কিছু নয়, এটা তো মানো, মঁসিয়ে ঝন্টু?”
আমি বললাম, “তা আর
বলতে। মেরী কম যদি আমাকে একটা ঘুষি মারে তাহলে কি হবে তা কি জানা নেই ভাবছেন?” সিমোন
হেসে বললেন, “বাহ, এই তো বুঝে
গেছো, ইউ আর আ
সুইট হার্ট। কিন্তু, তোমাদের রাজ্যে তো দেখছি সাংঘাতিক বাল্য
বিবাহ আর ট্র্যাফিকিং। অবশ্য মধ্যবিত্ত মহিলাদের অবস্থা ভালো হয়েছে অনেকটা। কেন
এরকম হল বল তো ঝন্টু?”
আমি বললাম, “চলো না
সিমোন, ময়দানে
বসে বাদাম খেতে খেতে আমরা এটা নিয়ে ভাবি”। সিমোন আমার দিকে তাকিয়ে বল্লো, “নটি বয়”।
বলেই মুচকি হেসে নেমে গেলো।
৫
বনগাঁ লোকালে কোনরকমে চিড়ে চ্যাপটা
হয়ে শেয়ালদায় নেমেছি, রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে, শার্ট প্যান্টটা ঠিক করছি, পিছন থেকে একটা
গম্ভীর গলা – “বলেছিলাম, উজবুক গুলো বুঝলো না”।
আমি বুঝতে পারলাম আবার কোনো সাহেবের
আগমন হয়েছে। ঠিক তাই, আজব পোশাক পড়ে এক লালমুখো সাহেব দাঁড়িয়ে পিছনে।
আমি বললাম, “চলুন একটু লেমন টি খাওয়া
যাক”। আমি চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “তা কী বলছিলেন আপনি স্যার?”
সাহেব করুণ মুখ করে বললেন, “জনসংখ্যার
চাপ একদিন সব শেষ করে দেবে। আসলে উজবুকগুলো বনগাঁ লোকালে চড়েনি তো কখনো”।
আমি বললাম, "এইটা আমিও বুঝতে পারছি। উফ বাবা, দুর্গা
পুজোর সময় ঠাকুর দেখা আর সম্ভব নয়। তিন মাইল লাইন সব প্যান্ডেলে। বাইপাসে
ট্র্যাফিক জ্যামটা দেখেছেন স্যার। গ্রামের দিকে ট্রেকারে মানুষ না বাদুড় ঝুলছে
বোঝা যায় না”।
আমি গ্যাস মারাতে সাহেবের মুখে একটু হাসি এলো, “তুমি বুঝছো ঝন্টু, কিন্তু উজবুক প্রফেসরগুলো বোঝে না। আসলে আমিও একটু ড্রামাবাজি করেছিলাম, মহামারীতে
সবাই মারা যাবে বলেছিলাম, খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে সেটা ভাবি নি, কিন্তু তুমিই বলো
ঝন্টু, এত জনসংখ্যা হলে কটা লোক বাঁচার মত বাঁচে?”
আমি বললাম, “স্যার, চাকরির যা অবস্থা, একটা পোস্টের জন্য এক
হাজার প্রার্থী। তা আপনার নামটা স্যার?” সাহেব কলেজ স্ট্রীটের দিকে এগিয়ে যেতে
যেতে বললেন, “ম্যালথাস, কল মি ম্যালথাস। দেখে নিয়ো- শেষ হাসি আমিই হাসবো”
৬
বিবেকা্নন্দ পার্কের পাশে ফুচকা সাটাচ্ছি,
কে যেন বলে উঠলো – “মর্কট্ ম্যালথাস কি বলছিল?”
আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম দাড়িওয়ালা একটি
সাহেব। আমি বললাম, “আপনি কার্ল মার্ক্স না?” সাহেব হেসে বললেন, “কার্ল বললেই চলবে”।
আমি বললাম “আমরা তো আবার সরাসরি নাম
ধরে বড়দের ডাকি না স্যার। তা আপনি ফুচকা খেতে ভালবাসেন তা তো জানা ছিল না।“
কার্ল সাহেব বললেন, “এই ওরিয়েন্টাল
খাবারটা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। খেতে তো ভালোই, আমি আর জেনি মাঝে মাঝেই খাই। কিন্তু
একটা সিরিয়াস ব্যাপারও আছে”।
আমি ফুচকা শেষ করে আলুর দম অর্ডার করে
বললাম, “সেটা কি স্যার?”
কার্ল সাহেব বললেন, “ক্যাপিটালিসমের
সাথে ডিভিশন অব লেবার, বড় বড় কারখানায় মাল তৈরী হবে এটা জানো তো ঝন্টু?”
আমি বললাম, “বিকম পড়ার সময় পড়েছিলাম
স্যার, খরচা কমে যায়”।
কার্ল সাহেব মুচকি হেসে বললেন, “ফুচকার
ক্ষেত্রে তা হল না কেন?”
আমি বললাম, “আপনার কি বুদ্ধি স্যার।
ঠিক ফুচকার কারখানা তো হয় নি, অথচ এত বিক্রি”।
কার্ল সাহেব বললেন, “আর এই যে লোকটা
বিক্রি করছে, তার মনে কি আনন্দ দেখেছো, কি গর্ব নিজের ফুচকা বিক্রি করে। কারখানার শ্রমিকদের
মধ্যে সেটা দেখতে পাবে?”
আমি বললাম, “না স্যার, ওরা তো কবে চাকরি
চলে যাবে তাই নিয়েই ভাবে শুধু”।
সাহেব বললেন, “আলুর দমটা খাসা করেছে
কিন্তু, জেনিকে বলতে হবে”।
৭
বুক ফেয়ারে বেনফিসের দোকানে ফিশ ওরলিতে
কামড় মেরেছি, আবার এক সাহেবের গলা – “বই কেনা হল?”
যাকে দেখলাম তাকে চিনতে পারলাম না।
বেশ কবি কবি চেহারা, গোল চশমা। মুখটা একটু করুণ।
আমি বললাম কি কি বই কিনেছি। সাহেব ব্যাজার
মুখে শুনে বললেন, “আমার বই আজকাল আর কেউ পড়ে না। বুঝলে ঝন্টু, ১৮৪০ সালে প্যারী শহরে
একটাই নাম, একটাই বই। প্যারীর আঁতেল মহল কেঁপে উঠেছিলো”।
আমি বললাম, “আরিব্বাস, আপনি তো ঘ্যামা লোক স্যার”। সাহেব
গ্যাস খেয়ে খুশি হল। সাহেব বলতে লাগলো, “একটা স্লোগান ছেড়েছিলাম, কেঁপে গেছিলো ক্ষমতায়
থাকা রাজা-উজির – ‘প্রপারটি ইস থেফট। ভূসম্পত্তির মালিক মানেই সে ডাকাতি করছে’”।
আমি বললাম, “স্যার কিছু বুঝলাম না”। সাহেব বললেন, “সোজা।
তুমিও নাগরিক আর আলিপুরের বড়লোক বাড়ির ছেলেও নাগরিক। বাপের সম্পত্তিতে র্যালা কে
মারবে?” আমি বললাম, “ও বুঝে গেছি। মাল হ্যায় তো চাল হ্যায়, বরনা তু কাঙ্গাল হ্যায়।
তা আপনার সেই বইটা কি হল”?
সাহেব আমার বাকি ফিশ ওরলিটা ঝেড়ে দিয়ে বললেন, “কি আর হবে,
লাইব্রেরীতে উইয়ে খাচ্ছে আর কি”। আমি বললাম, “কিন্তু স্যার আপনার নামটা?” সাহেব
বললেন, “এই দেখো, নিজের পরিচয়টাই দিই নি। আমি পিয়ের, পিয়েরোজসেফ পুঁদো। চল একটা
ফিশ ফ্রাই হয়ে যাক এবার।“
৮
সি.ইউ.’তে একটা এল.আই.সি পলিসি বেচে বেড়িয়েছি, আবার
ফুকোদার সঙ্গে দেখা ন্যাশানাল লাইব্রেরির সামনে।
আমাকে দেখেই বললেন, “আরে তোমার ওপর সেদিন চটে গেছিলাম, ঠিক করিনি।
চলো একটু ঝালমুড়ি খাওয়া যাক”। আমি বললাম, “আরে না না, চলুন, একটা পলিসি বেচে
দিয়েছি। মেজাজ খুশ হ্যায়। কিন্তু আপনি প্যারী ছেড়ে এখানে কী করছেন?”
ফুকোদা বললেন, “আরে বস ইউরোপ তো আমার বোঝা হয়ে গেছে,
ইন্ডিয়াটাই বুঝতে পারছি না, বিশেষ করে এই তোমাদের পশ্চিমবঙ্গ। এখন সমস্ত সাহেব ভূত
এখা্নে দেখছো না। হতচ্ছাড়া জন স্টুয়ারট মিলটাও এসে জুটেছে দেখলাম”।
আমি বললাম, “তা আপনি কি বুঝতে পারছেন না বলুন তো? পলিসি
বেচার জন্য আমাদের অনেক রকম চোতা পড়তে হয়, অভিজ্ঞতা হয়, দেখি সাহায্য করতে পারি কি
না”।
“কঠিন ব্যাপার। ইউরোপে নানা রকম প্রতিষ্ঠান কেমন করে জনগণের
মগজধোলাই করে সেটা তো আমি দেখিয়েছি, নো প্রবলেম। কিন্তু এখানে এই ‘গভর্মেন্ট’
ব্যাপারটা তো বুঝতে পারছি না”।
আমি বললাম, “আরেকটু বুঝিয়ে বলুন দেখি, এই নিন গোল্ড ফ্লেক
চলবে তো?”
ফুকোদা কাউন্টারটা নিয়ে বললেন, “আসলে পাশ্চ্যাত্তে গভর্মেন্ট
যেটা করতে চায় করে ফেলে। স্কুল বানিয়ে মগজ ধোলাই করবে ঠিক করলে সেটা করে ফেলে,
আবার নাৎসিদের মত মানুষ মারতে চাইলেও মেরে ফেলে, আবার তার রেকর্ডও রেখে দেয়।
কিন্তু এখানে তো দেখছি গভর্মেন্ট যাই করতে যায় সেটাই ধেড়িয়ে দেয়। কোনো কিছুই ঠিক
চলছে না, কিন্তু আবার চলছেও। ওই দ্যাখো বাসটা বাসস্ট্যান্ডে না দাঁড়িয়ে দশ মিটার দূরে দাঁড়ালো। আর লোকগুলো পিছন
পিছন ছুটলো। সরকার স্কুল করেছে, কিন্তু মগজধোলাইটা করবে কে? বহু টিচারদের তো
পড়ানোর ইচ্ছেই নেই”।
আমি বললাম, “বুঝলাম, এটাই তার মানে আমাদের প্লাস পয়েন্ট”।
৯
“একটু দেরি করে ফেললাম কি?”
একটা কাজে ডালহৌসি পাড়ায় এসেছিলাম, কাজ মানে ওই এল আই সি
বেচা আর কি, ভাবলাম একটু ফেয়ারলির কাছে বিরিয়ানি খেয়ে যাই।
মটনের পিসটাতে কামড় বসানো মাত্রই আবার এক সাহেবের গলা। ঘাড়
ঘুড়িয়ে দেখলাম যে সাহেবের সাদা চুল আর মুখে পাইপ।
আমি বললাম, আরে আপনাকে কোলকাতায় কে না চেনে, সেই নব্বই
দশকের মাঝামাঝি আপনি বুক ফেয়ারে এসেছিলেন জীবিত অবস্থায়। তখন আপনার বই কলেজ
স্ট্রীটে সিডনি শেল্ডনের বইয়ের চেয়েও বেশী বিক্রি হতো।
সাহেব হেসে উঠলো। তারপর বললেন, “ঠিক, কোলকাতাতে আমি, মানে
আমার কাজকর্ম, পৌঁছতে একটু দেরি হয়েছিলো বটে। তবে আমিও তো এ দেশের কিছুই পড়িনি।
তাই আমারও দেরি হয়ে গেছে। আবার এসে দেখছি অনেকেই আমার আগে পৌঁছে গেছে। ওই টেকো
ফুকোর সাথে তোমার বেশ দহরম-মহরম দেখতে পাচ্ছি।“
আমি বিরিয়ানির প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “তা এখন কী ভাবছেন
স্যার”। সাহেব বললেন, “অনুপম রায়ের লিরিক্স পড়ছি, কিছুই ধরতে পারছি না। বাইনারি, আপরিয়া,
দি কন্সট্রাকশান – সবই ফেল মেরে যাচ্ছে। যাই হোক, দেরিতে হলেও বুঝতে পারবো আশা করি”।
আমি বললাম, “এই নিন, মটন বিরিয়ানির পর চিকেন চাপ। লাইফে চাপ
নেবেন না দেরিদাদা। ট্রাম লাইনে কান পাতলেই ধরে ফেলতে পারবেন”।
১০
মনে হল দম নিতে পারছি না। কেউ যেন গলাটা টিপে ধরে রেখেছে।
চোখ খুলে দেখি সত্যিই তাই। এক দানবের মত চেহারার লোক আমার
গলাটা টিপে ধরে রেখেছে। প্রায় সাড়ে ছয় ফিট উচ্চতা, রক্তাক্ত চোখ, মুখে এক গাল
দাড়ি, লম্বা নাক, এক কথায় দানবীয় চেহারা। আমি কোনরকমে মিন মিন করে বললাম, “আমি কি
দোষ করেছি স্যার?”
দানবীয় লোকটি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে বলল, “শালা, কার্ল
মার্ক্সের সাথে ফুচকা খাওয়া হচ্ছে? হারামিটা কোথায়? তাকে খবর দাও, বাকুনিন ইস ইন
টাউন। বদলা নিতে এসেছি। কাঠি করে আমাকে ফুটিয়ে দিয়েছিল ১৮৭২ সালে। এইবার দেখে নেবো।”
বলে সে আমার গলাটা ছাড়লো। আমি বললাম, “স্যার, আমি তো এল আই
সি বেচি, এই সব হাই-ফাই ব্যাপারে আমি কি করবো বলুন। ঠিক আছে আমি খবর দিয়ে দেবো”।
“ওকে, নামটা শোনা নেই নিশ্চই। উকিপিডিয়া দেখে নিও”।
আমি একটু বাদে মার্ক্স সাহেবকে খবর দিলাম। উনি বললেন,
“হ্যাঁ, অ্যানারকিস্টগুলো এসে জুটেছে শুনতে পাচ্ছি। পুঁদো আর বাকুনিন। আমার ওপর
রাগ থাকাটা স্বাভাবিক। আর এটাও ঠিক যে বাকুনিন বলতো যে আমি রাষ্ট্রকে বেশি পাত্তা
দিই। ওটা নিয়ে আমি এখন ভাবছি”।
১১
এতদিন ধরে একজন একজন সাহেব অথবা মেম
দেখা দিচ্ছিল, এবার নতুন কেস। প্রিন্সেপ ঘাটে দেখি এক সাহেব আর এক মেম তুমুল ঝগড়া করছে। এই মারে তো সেই মারে। আমি বললাম, “আহা কি মুশকিল, আপনারা
এত ঝগড়া কেন করছেন?”
সাহেব মেম দুজনেই আমার দিকে অবাক হয়ে
তাকালো। তারপর মেমসাহেব মুচকি হেসে বললেন, “আরে ঝন্টু, আমরা তো সেই ১৮৯৯ সাল থেকে ঝগড়া করছি”।
আমার চক্ষু ছানাবড়া দেখে মেম হেসে ফেললেন। তারপর মিষ্টি
হেসে বললেন, “আমি রোজা, রোজা লুক্সেম্বার্গ আর ইনি আমার বন্ধু এডোয়ার্ড
বার্ণস্টাইন। “সাহেবও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “আমার নামটা আপনাদের শহরে ঠিক পাত্তা
পায় নি, তবে রোজার অনেক প্রেমিক আছে কোলকাতায়”।
রোজার প্রেমেতো ততক্ষণে আমিও পড়ে গেছি। উফ কি কাতিল দৃষ্টি।
মাথার উপর সুন্দর একটা ছোট্ট টুপি, বেশ একটা আরিস্টোক্র্যাটিক ঘ্যাম আছে। সাহেবের
চোখে গোল চশমা। হাল্কা দাড়ি। বেশ একটা ভাবুক ভাবুক ভাব।
আমি বললাম, “আমি ঝন্টু, ঝন্টু দাশ। এল আই সি এজেন্ট”। রোজা
বললেন, “ঝন্টু, তোমার কথা সবাই জানি আমরা, তুমি তো সেলিব্রিটি আমাদের কাছে”। আমি
বললাম, “কি যে বলেন, ভালো একটা চাকরি পেলাম না, তাই এই সব এল আই সি বেচে দিন চলে
যায় আর কি। তা আপনারা কি নিয়ে ঝগড়া করছেন?”
রোজা সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমিই বলো তোমার অপকীর্তির
কথা।“
এডুয়ার্ড সাহেব হেসে বললেন, “১৮৯০ এর দশকে একটা বড় বিতর্ক
ছিলো বামপন্থীদের মধ্যে – বিপ্লব করেই ধনতন্ত্রের পতন ঘটাতে হবে না ছোট ছোট
পদক্ষেপেও, বিপ্লব না করেও, গরীব লোকের উন্নতি করা যায় কি না। আমার ছিল দ্বিতীয়
বক্তব্য আর সেই জন্য রোজা আমার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক একটা বই লিখেছিল, আমার বক্তব্যকে
তুলোধনা করেছিল। যদিও শেষ হাসি আমিই হেসেছি”।
রোজা মেমসাহেব মুচকি হেসে বললেন, “ইতিহাস কি শেষ হয়ে গেছে
নাকি? যত্তসব”।
আমি বললাম, “বাহ, আমাদের এখানেও তো এই ঝগড়াটা চলছে সিপিএম
আর নকশালদের মধ্যে। তা প্রায় ষাট বছর হল, কিন্তু এদিকে দুই পক্ষেরই অবস্থা টাইট।
কিন্তু ঝগড়া চলছে”।
সাহেব মেম দুজনেই হেসে বললেন, “আমাদের তো ঝগড়া করার মধ্যে
দিয়েই প্রেম”। আমি বললাম, “আচ্ছা আবার একদিন কথা হবে, এখন একটা পলিসি বেচতে যেতে
হবে।“
১২
জেনি বউদি বলেছিল, “ঝন্টু একদিন আমাদের
বাড়িতে খেতে এসো”।
এই মওকা ছাড়ার কোনো মানে হয় না। এমনিতেই
আমি পেটুক মানুষ, ঝালে ঝোলে অম্বলে জেলুসিলে থাকতে ভালবাসি, তায় আবার কার্ল সাহেবের
বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।
এঙ্গেলস সাহেবও এসে গেছেন কোলকাতায়।
জেনি বৌদি মার্ক্স সাহেবকে দিয়ে লেক মার্কেট থেকে সবজি, মাছ, মাংস বাজার করান। আমাকে
হেসে বললেন, “বুঝলে ঝন্টু, আজকাল একটু বাড়ির কাজ করছেন তোমার সাহেব”।
আমি বললাম, “বাঃ বাঃ, এতো খুবই ভালো
খবর। বাজার করতে করতে নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা আসছে নিশ্চই স্যারের”।
জেনি বউদি হেসে বললেন, “সে তো মাথায়
সবসময়ই চিন্তার
ঝড় চলছে। থামলে বাঁচা যায়। দিব্বি এক কালে প্রেমের কবিতা লিখতো, আমাকে নিয়ে, তারপর
কি যে ভূত মাথায় চাপলো”। এঙ্গেলস সাহেব শুনে হাসতে হাসতে বললেন, “ভূত বলে ভূত। যাই
হোক বউদি, সরষে ইলিশটা দারুণ হয়েছে”।
মার্কস সাহেব মাছ-ভাত খাওয়া শেষ করে, চুরুটটা ধরিয়ে আমাকে বললেন, “এই ইলিশ মাছ
ব্যাপারটাও আমাকে খুব ভাবাচ্ছে, বুঝলে ঝন্টু।“
আমি বললাম, “এই মেরেছে, এতো চেটে পুটে খাবার ব্যাপার, ভাবার কি আছে?”
সাহেব চুরুটে টান দিয়ে বললেন, “তা ঠিক, কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার হচ্ছে যতই দাম বাড়ুক
না কেন বাঙালি ইলিশ খাবেই। এদিকে রান্নার গ্যাসের দাম অল্প বাড়লে আন্দোলন শুরু হয়ে
যাবে। তাছাড়া বড় বড় শপিং মলে ইলিশ বিক্রি হলে কেউ কিনবে না, সেই পাড়ার বাজার থেকেই
কিনবে। মাছওয়ালার সাথে ঝগড়া না করলে চলবে না। শপিং মলের জনপ্রিয়তা কমেনি, কিন্তু
ইলিশ মাছের বেলায় বাজারে গিয়ে ঝগড়া না করলে নয়। মনে হচ্ছে নতুন করে যে একবিংশ শতকের দাস ক্যাপিটালটা লিখতে
শুরু করবো কিছুদিনের মধ্যে, সেটা ইলিশ মাছ দিয়েই শুরু করতে হবে। আসলে ক্যাপিটাল
ব্যাপারটাই ফিসি”।
এঙ্গেলস সাহেব বললেন, “তা এই দাস ক্যাপিটালটা
শেষ হবে কি?”
১৩
“আঁতেল হয়ে যাচ্ছো ঝন্টু। ওই সব দেড়েলদের সাথে বেশি মিশতে
যেও না, মাথাটা চিবিয়ে খাবে”।
একটা পলিসির প্রিমিয়ামের চেক কালেক্ট্ করে একটু গড়িয়াহাটায়
মোগলাই খাচ্ছি, আবার এক সাহেবি গলা। আমি বুঝলাম যে অবস্থা টাইট, আবার কেউ একটা এসে
গেছে। আমি বললাম, “স্যার, মোগলাই পরোটা চলবে নাকি? ইউনিক খাবার, বিদেশে পাবেন না”।
সাহেবের মুখটা দেখলাম একটু ফোলা ফোলা, আর কি কাণ্ড,
দাড়ি-গোঁফ নেই। ভারিক্কি চেহারা, দেখেই মনে হয় খুব বুদ্ধি মগজে। সাহেব হেসে বললেন, “না, আমি জ্যাকেট
পোটাটো খেয়ে বেরোলাম একটু আগে”।
আমি
বললাম, “স্যার, আমি তো পলিসি বেচে খাই, আঁতেল কি করে হবো? তবে আপনার মত লোকেদের
মিট করতে পারছি এটাই সৌভাগ্য”।
পলিসি
বেচতে গিয়ে একটা বিষয় শিখেছি – গ্যাস দিলে সবাই খুশি হয়। এমনকি ভূতেরাও খুশি হয়,
যা দেখছি। এই সাহেবও খুশি হলেন।
“ঝন্টু,
ফরাসি বিপ্লবের কথা শুনেছো তো?” আমি বললাম, “স্কুলে পড়েছিলাম স্যার। এখন ভালো মনে
নেই। এক ইতিহাসের অধ্যাপকের পলিসিটা আমি দেখি, উনি সেদিন একটা বই দেখাচ্ছিলেন। ইয়া
মোটা, সিটিজেন্স না কি যেন নাম।“
সাহেব
বললেন, “ও সাইমন শামা। এরা তো আজকের ছোকড়া। ১৭৯০ সালে যখন ঘটনাটা ঘটছে, তখনই আমি বলেছিলাম
যে মহা সর্বনাশ হতে চলেছে। হলও তাই। রক্তারক্তি, মারামারি, টেরর। সেই থেকে আজ
অব্দি এই বিপ্লবীগুলো একই কাণ্ড করে আসছে। ইতিহাসের শিক্ষা নেবে না কিছুতেই”।
আমার
মোগলাই খাওয়া শেষ হল। আমি বললাম, “তা স্যার আপনার যুক্তিটা কি?” সাহেব বললেন,
“আসলে সমাজ গড়ে ওঠে বহুদিন ধরে, আস্তে আস্তে, নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষার মধ্যে দিয়ে।
আর এই বিপ্লবীগুলো চায় সবকিছুকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে একটা নতুন সমাজ বানাতে।
কখনো পারা যায় সেটা? দেখলে রাশিয়ায় কি হল? ওই যে তোমার লেনিনদা, যত নষ্টের গোড়া।”
আমি
বললাম, “আপনি কি দারুণ ভাবেন স্যার। আপনার নামটা জানি না, সরি।“ উনি বললেন,
“বার্ক, এডমান্ড বার্ক।“ আমি বললাম, “কোন দেশ স্যার?” বললেন, “ইংল্যান্ড”।
আমার
মাথায় তখন একটা প্রশ্ন খেলে গেল। আমি বলে বসলাম, “আচ্ছা স্যার, রাশিয়ার সব কিছুই
কি ফেলে দেওয়া উচিৎ?”
বার্ক
সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “পুরোটাই তো ভেঙ্গে পড়লো, দেখো নি?” তখন আমার সেই
ইতিহাসের অধ্যাপকের একটা কথা মনে পড়ে গেলো। বললাম, “আচ্ছা স্যার, রোমানদেরও তো পতন
হয়েছিলো, তাই বলে আপনারা তো রোমের সব কিছু ভুলে যাননি”।
সাহেবের
মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, “এখন চলি, একটা জরুরি কাজ আছে। কিন্তু দেড়েল হইতে
সাবধান”।
১৪
“ভূতলোকে আপনিতো এখন এক নম্বর সেলিব্রিটি। আমার কথাটা একটু
ভাববেন না?”
আমি সবে বাজার থেকে সবজি কিনে এনে দাড়িটা কামাতে শুরু
করেছি, হঠাৎ পিছনে আরেক সাহেবের আবির্ভাব। উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয়ের মত, বেশি লম্বা
নয়, মাথায় টাক, বেশ গাট্টা গোট্টা চেহারা, একটু রাগী, অভিমানী মুখ।
আমি বললাম, “স্যার কি যে বলেন। আপনাদের কথা শুনতে পাচ্ছি,
এটাই আমার সৌভাগ্য। সরি, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। সিটি কলেজ থেকে বিকম পাশ,
বুঝতেই পারছেন। এখন পলিসি বেচে খাই”।
সাহেবের চোখে জল। বললেন, “হতচ্ছাড়া হিটলারের আত্মজীবনী
কোলকাতার ফুটপাথে পাওয়া যায়, অথচ আমারটা পাওয়া যায় না, অনেকে তো জানেই না আমার
জীবনের কথা। অথচ দেখুন, ফ্যাসিজিমের আসল গুরু তো আমি। এই যে বাঙালিদের মধ্যে
ফ্যাসিজিম জনপ্রিয় হচ্ছে, কৈ আমার একটা স্ট্যাচু কি হল? হয় নি। এটা কি অন্যায় নয়?”
আমি একটু গ্যাস দিয়ে বললাম, “তা ঠিক। আমিই তো আপনাকে চিনতে
পারছি না। খুব অন্যায়। নামটা একটু বলবেন স্যার?”
“বেনিত্তো মুসোলিনি। ভেবে দেখবেন, বাঙালি আজকে আমার চিন্তা
ভাবনা অনুযায়ী চলছে, কিন্তু আমাকে সম্মান দিচ্ছে না”।
আমি বললাম, “স্যার, একটু বুঝিয়ে বলবেন?”
সাহেবের মুখ লাল হয়ে গেল। রেগে গিয়ে বলতে লাগলো, “বাঙালি তো
কালচারাল সুপিরিওরিটিতে বিশ্বাস করে, আমরাও করতাম। ইটালিই ইয়োরোপকে সভ্যতা দিয়েছে।
তেমনি হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে...তোমাদের মন্ত্র”।
আমি বললাম, “ঠিক। তারপর?“
সাহেব বললেন, “তোমরা ক্যালাকেলির রাজনীতিতে বিশ্বাস করো,
আরে বাবা আমিই তো শুরু করেছিলাম। ওসব ডিবেট টিবেট দিয়ে মাতৃভূমির রক্ষা হয় নাকি?
ধুস”।
আমি বললাম, “তা মিল পাচ্ছি বটে, তবে আমি স্যার একদমই
জেলুসিল খাওয়া টাইপ। আপনার পছন্দের স্যাম্পেল আপনি বীরভূমের দিকে পাবেন। বীরেরা ওই
দিকে থাকে”।
সাহেব হেসে বললেন, “জানি তো। বাংলার আসল গুরু তো আমি। তবে
বাঙালিদের একটা প্রবলেম আছে”।
আমি বললাম, “সেটা কি স্যার?”
মুসোলিনি সাহেব বললেন, “লিবারালিসম বা কমিউনিজম কোনোটাই ঠিক
করে করতে পারো নি, ফ্যাসিজমটাও হয়তো ধেরিয়ে দেবে। খালি লুচি, আলুর দম আর সন্দেশ
রসগোল্লার লোভ করলে কি হবে?”
আমার মনে পড়ে গেল যে অনেকদিন রসগোল্লা খাওয়া হচ্ছে না।
১৫
“বোকা বার্ক কী বলছিলো?”
হো চি মিন সরণী তে আমেরিকান কনসুলেটের
পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম, হঠাৎ এক সাহেবের গলা। দেখলাম, ঠিক তাই। বেশ দেখতে সাহেবকে। দাড়ি গোঁফ নেই, লম্বা নাক, বেশ স্টাইলিশ
চুল, চোখে মুখে একটা বুদ্ধির ছাপ। মুখে স্মিত হাসি।
আমি হেসে বললাম, “আপনারা দুজনে খুব বন্ধু মনে হচ্ছে”।
সাহেব হেসে বললেন, “সাধে কি ঝন্টু দাশ ভূতলোকের এক নম্বর সেলিব্রিটি? এই ভাবে
আমাদের সাথে অনেকদিন কেউ কথা বলেনি”- বলেই তিনি বেশ খানিকক্ষণ হেসে নিলেন।
আমি বললাম, “আমি পলিসি বেচে খাই স্যার, বেশী কিছু জানি না।
আপনাকেও ঠিক চিনতে পারলাম না। তবে আপনাদের সাথে আলাপ হয়ে অনেক কিছু শিখতে পারছি,
এটা ঠিক”।
সাহেব বললেন, “তোমার সাথে কথা বলেও আমরা অনেক কিছু শিখতে
পারছি। যাই হোক, আমার নাম টমাস পেইন”।
আমি বললাম, “আচ্ছা। আপনার বক্তব্যটা কি?”
সাহেব একটু করুণ গলায় বললেন, “আমার কথা এখন আর কেউ শোনে না
বুঝলে। আমার নিজের দেশেই কেউ শোনে না, বাকি পৃথিবীর কথা তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু এককালে
আমার একটি পুস্তিকা আমেরিকায় বিপ্লব এনে দিয়েছিল। বইটার নাম ছিল কমন সেন্স। ১৭৭৬
সালে ছাপা মাত্রই এক লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। সে এক রোমাঞ্চকর সময়, ইংল্যান্ডের সাথে লড়াই করে
স্বাধীনতার
পথে হাঁটছে আমেরিকা।
এই পুস্তিকা পড়ে আমেরিকার মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে”।
আমি বললাম, “এক লাখ কপি? এ তো চেতন ভগতেরও স্বপ্ন মশাই। তা এই বইতেই কি
বার্ক সাহেবের বিরুদ্ধে কামান দাগলেন নাকি?”
সাহেব
হেসে বললেন, “না ওটাতে যুক্তি দিয়ে সহজ ভাষায় বলেছিলাম কেন অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুন
করে এক গণতান্ত্রিক দেশ তৈরি করতে হবে। বার্কের প্যান্ট খুলে দিয়েছিলাম দি রাইটস
অফ ম্যান বইতে। ও যে ফরাসী বিপ্লব নিয়ে ভুলভাল বলছিলো সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম”।
আমি
বললাম, “বাঃ, আপনি তো ওস্তাদ লোক মশাই। তা এখন কোলকাতায় কেন?”
সাহেব
বললেন, “আসলে এক কালে গণতন্ত্র নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিলাম, এখন সেটা সারা পৃথিবীতে
কী চেহারা নিয়েছে, সেটা বুঝতে চেষ্টা করছি। এখানে তো একই পার্টি অনেক দিন ধরে শাসন
করে দেখছি। বেশ একটা সাম্রাজ্য বানায় তারপর তাদের পতন হয় আবার আরেক পার্টির
সাম্রাজ্য শুরু হয়। বিরোধীরা খুব একটা কল্কে পায় না”।
আমি
বললাম, “ঠিক ধরেছেন স্যার। এটাই বাঙালির গণতন্ত্র”।
সাহেব
বললেন, “রাজতন্ত্রকে যখন খিস্তি মেরেছিলাম তখন এইটা কল্পনা করিনি”।
আমি
বললাম, “কিন্তু স্যার, আপনার দেশের গণতন্ত্রের অবস্থাও তো খুব একটা সুবিধার নয়
বলেই শুনেছি”।
সাহেব বললেন, “তা ঠিক। সব কিছু দেখে আমার কলম আটকে গেছে
বুঝলে”।
আমি বললাম, “তা পার্ক স্ট্রীটে গিয়ে একটু বিয়ার আর বিফ
স্টেক হবে নাকি? নতুন একটা কমন সেন্স লেখার আইডিয়া পেয়ে যেতে পারেন”।
সাহেব বললেন, “গুড আইডিয়া ঝন্টু”।
১৬
“একটা শব্দ, বুঝলে ঝন্টু, একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলাম। তার ফলে কত স্কলারের
চাকরি হল, কত স্কলার সুপারস্টার হয়ে গেল।“
আমি ট্যাংরায় চিলি চিকেন প্যাদাচ্ছি, হটাৎ দেখি এক তরুণ
সাহেব। মিষ্টি দেখতে, মাথায় উস্কো–খুস্কো চুল, চোখে গোল চশমা। দেখলেই বোঝা যায়
অসম্ভব মেধাবী। মেয়ে মহলে জনপ্রিয় হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমি বললাম, স্যার, “চিলি চিকেন চলবে?”
সাহেব বলল, “চীনে মার্কসবাদ আর চিলি চিকেন কোনটাই আমার পেটে
সহ্য হবে না ঝন্টু। আমার নরম ইউরোপীয় পেট আর রোমান্টিক মন”।
আমি হেসে বললাম, “তা স্যার, কোন একটা শব্দের কথা বলছিলেন”।
সাহেব আবার তার টপিকে ফেরত এলেন। বললেন, “সাব-অলটার্ণ”।
আমি বললাম, “সেটা কি স্যার, জানি না তো”।
“ইতালিতে বামপন্থী রাজনীতি করতে গিয়ে জেলে যেতে হয়েছিল।
সেখানে বসে একটু লেখা লেখি করছিলাম। নানা রকম কোডেড শব্দ ব্যবহার করতে হতো, যাতে
পুলিশ ধরতে না পারে। সেই রকমই একটি শব্দ – শ্রমজীবি মানুষের বদলে সাব-অলটার্ণ”।
আমি বললাম, “যেমন আমি?”
সাহেব বললেন, “বলতে পারো। তখন অবশ্য তোমার মত লোকের কথা
মাথায় ছিলো না। তবে চলবে”।
আমি বললাম, “তারপর?”
সাহেব বললেন, “ইউরোপে বামপন্থী আন্দোলন তো ঘন্টা হল, কিন্তু
আশির দশক থেকে ভারতীয় ইতিহাস লেখালেখিতে এই শব্দটা কামাল করে দিল। কত বই, পেপার,
সেমিনার। কেউ কেউ তো আমেরিকাতে সুপারস্টার হয়ে গেলো। শ্রমজীবি মানুষ অবশ্য
ক্যালানে টাইপ, ওদের কিছু হল না।“
আমি বললাম, “এ তো পুরো ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল, হামেশাই
হচ্ছে”।
সাহেব হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “তবে আমি কিন্তু আসল সাব-অলটার্ণ
এবার পেয়ে গেছি”।
আমি বললাম, “তাই স্যার, কোথায়?”
সাহেব বললেন, “দেখবে? চলো”।
আমি বিল মিটিয়ে উঠলাম। বাইরে বেরিয়ে বললাম, “আরে স্যার,
আপনার নামটাই তো জানা হল না”।
সাহেব এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “আন্তোনিয়ো, আন্তোনিয়ো গ্রামশ্চি।“
আমি আর সাহেব বাইপাসের মোড়ে এসে দেখি বাইপাস স্তব্ধ। সব
গাড়ী আটকে আছে। সাহেব মুচকি হেসে বললেন, “ওই দ্যাখো।“
আমি দেখলাম প্রায় এক লাখ নেড়ি কুকুর দাঁড়িয়ে আছে।
সাহেব আবার বললেন, “ওই দ্যাখো”।
আমি দেখলাম আকাশে কয়েক হাজার কাক।
সাহেব বললেন, “ফৌজ তৈরি। এবার আমাকে কে আটকাবে?”
নতুন ধরণের লেখা। ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনপ্রয়োজনীয় লেখা। বর্তমান ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য।
উত্তরমুছুনকঠিন কথাগুলো কত সহজ করে বলা যায় সমগ্র লেখাজুড়ে তার প্রতিযোগিতা চললো। সমৃদ্ধ হলাম।
উত্তরমুছুনpolitical economy r sahaj path..darun
উত্তরমুছুন