দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা




আত্মকথা

কবিতার কাছে আজ এসো, ছায়াহীন। এসো
জরা, ক্ষয়, বিস্মৃতির ভয় ঝেড়ে ফেলে।
আনো অন্তরিক্ষলীন অমিত বেদনা। তার
অষ্টাঙ্গে বাজুক রিনিরিনি জ্যোৎস্না আর হাওয়া।

আকাশে আজ মেঘ নেই। জ্যোৎস্নাও নেই আজ। গাছে গাছে অন্ধকার জাল বিছানো রয়েছে।
হাওয়া নেই বলে পাতাদের প্রতিস্বরও নেই কোথাও। কেবল এক ছায়াপুরুষ তার অমেয় দৈর্ঘের
পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। নির্ভার আর নিঃশব্দ সেই পদসঞ্চারে ত্রস্ত আজ শীর্ণ নদীটি।

নদীর কাছেই তবে যাই চলো, রাত্রিটির কাছে।
ধরিত্রী এখানে তার অশ্রুবিন্দুগুলি নিয়ে আজও জেগে আছে,
যেন কোনো কথাহীন সুর-
না-বলা কাহিনি কোনো বিষাদবিধুরঃ
-   কী আছে তোমার নদী, শীর্ণ জলবতী?
-   কিছু নেই, অল্প কিছু মূল্যহীন স্মৃতি।
-   বলা যাবে সেই সব?
নদীটি নীরব।

সেই মুহূর্তেই দূরের পাহাড় থেকে ধেয়ে এল মসীলিপ্ত বাতাস। অন্ধকারের প্রবাহ যেন। তীরের
গাছগুলিতে লেপ্টে থাকা জোনাকিরা এই প্রথম নজরে এল।
-   কী বাধা, কোথায় বাধা ব লো?
নীরবতা ভেঙে নদী এইবার অশ্রু-ছলোছলোঃ
-   বাধা যোগাযোগে। সেই সব কাহিনির ভাষা
সম্পূর্ণ বিস্মৃত আজ। অচল, বিকলও।

মাথা নিচু করে শুনি।
মাটির ভেতরে যেন বেজে চলে নাছোড় ঝুমঝুমি।
ভাবি-
কোন বনান্তরে কবে হারিয়েছি সিন্দুকের চাবি?
ভুল নামে ভুল গোত্রে ভুল পরিচয়ে
অশ্রুহীন অস্মিতায়, ভ্রমের আবহে
নিজেকেই কবি ভেবে এখানে এসেছি এই কীর্ণ অন্ধকারে
জোনাকির আলো মাখা পাতাদের মর্মরে মর্মরে
যে ছন্দ যে সুর যেই উতল স্তব্ধতা, আমি তার
কিছুই বুঝিনি, আজ ব্যর্থ হাহাকার
তোমাকে আঘাত করে, তোমাকেও ক্লান্ত করে রাই।

মাটির ভেতরে শোনো বেজে উঠল আরক্ত সানাই।।



একদিন মূর্ছা ভেঙে গেলে

দেখব ছবির পাহাড়, মাঠ, উপত‍্যকা। আদিগন্ত লাল-নীল হাওয়া।
দেখব অযূত ফড়িং উড়ছে, নির্বিকার, ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেহিসেবি মাছ।
একটি যৌবনগন্ধ -- মহুয়ার-- বহুদূর থেকে ঘিরে রাখবে আমাদের
                                            সমভূমির অফুরান দিগন্তের মতো।


তুমি কি দেখবে কিছু ? আমাকে অন্তত ? নাকি পাহাড়ি কন্দের খোঁজে
                              বেরিয়ে পড়বে হৈ হৈ ভোরের হাওয়ায় ?
চূতলতিকার রেনু গায়ে মেখে ফিরে আসবে-- হাহা হাসি, ভুল খবর ছিল।
জানো, তরুণ কবির মৃত‍্যু একদম ভুল খবর, কিস‍্যু হয়নি, এইমাত্র ফোন
জানো, কেউ কোথাও মাইন পাতেনি, জানো, রাজসাক্ষী হয়নি কেউ, একদম
                                                                       ডাহা মিথ‍্যে, ভুল।


উৎসবের রং লাগবে চোখে-মুখে, স্বভাব চটুল হাওয়া আসবে দক্ষিণ দিগন্ত
                                                                                      থেকে
আমাদের লাজুক নদীটি
হেসে হেসে উঠবে আর একবার , কাশফুলের স্মৃতি নিয়ে উজ্জ্বল বালির চর
শিউরে উঠবে আহ্লাদে আহ্লাদে


সন্ধ‍্যায় নাচ হবে। উন্মত্ত শবর, আহা পাগল শবর।
চাঁদ উঠবে -- মহাকায় শালবনের আঁধার আড়াল থেকে
       গল্পে শোনা শ্বেত হস্তীটির মতো নির্বাক, করুণ।
সেদিনও তোমাকে দেখব -- একটি গোপন কথা, আমাকেই বলবে বলে

অবকাশ খুঁজছ আর হেসে উঠছ অজান্তেই, সুযোগ পাচ্ছ না।


ছবিঃ অর্ণব নন্দী

1 টি মন্তব্য:

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com