বিশ্বমাতৃদিবসে একটি
সাক্ষাৎকার
সাংবাদিক- নমস্কার মাসিমা আমি মঞ্জরী মিত্র। দৈনিক
পাঞ্চজন্যর পক্ষ থেকে বিশ্বমাতৃদিবস উপলক্ষে একটা বিশেষ সংখ্যা বের হচ্ছে তাতে
বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বিভিন্ন মায়েদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা সাম্প্রতিক সামাজিক চিত্র
তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি আজ এসেছি আপনার সঙ্গে কথা বলতে। প্রথমেই আমাদের
পত্রিকার তরফ থেকে এই বিশেষ দিনটিতে আপনাকে শুভকামনা জানাই। মাসিমা আপনার নাম আর বয়স দিয়ে শুরু করি তাহলে?
মাসীমা-
আমার নাম বলাকা সেন। বিয়াল্লিশের ভারতছাড়ো আন্দোলন এর সময় আমার জন্ম, সেই হিসেবে সাতাত্তর বছর হলো।
মঞ্জরী
মিত্র - বাঃ কী সুন্দর নাম। মাসিমা আপনার ছোট বেলার গল্প একটু বলুন।
বলাকা
সেন- আমার বাবা ছিলেন বাঙলার শিক্ষক। সেই আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায়
এম.এ। আমাদের তিন বোনের নামই বাবার দেওয়া, আমি বলাকা, আমার
পরের বোন চৈতালী আর ছোট বোনের নাম মানসী। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আর কী!
মঞ্জরী
মিত্র - কোথায় জন্ম মাসিমা আপনার?
বলাকা
সেন - এখনকার বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাগেরহাট এ। ছোটবেলাটা আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত
বাড়ির বাচ্চার মতোই কেটেছে।যদিও সে কালে মাষ্টারদের মাইনেকড়ি তেমন ছিলো না কিন্তু
বাবা ছিলেন দাদুর একমাত্র সন্তান, জমিজমা
ছিলো- খাওয়াপরার কষ্ট কখনও বুঝিনি।অবশ্য বাবা-মায়ের সংসারে আর ক'দিনই বা থাকলাম!
মঞ্জরী
মিত্র - কেন মাসীমা? একটু
বিস্তারিত বলুন না।
বলাকা
সেন - আমার যখন দশবছর বয়স, ক্লাস
ফাইভে পড়ি তখন মাত্র তিনদিনের জ্বরে বাবা মারা গেলেন। আমার পরের বোন তখন ছয় আর ছোট
বোনের বয়স দশমাস।পঁচিশ বছর বয়সে তিনটে মেয়ে নিয়ে মা বিধবা হলেন।সবে দেশ স্বাধীন
হয়েছে - ও দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাবারই ছিলো নৈলে আত্মীয় স্বজন সিংহভাগই
ততদিনে এদেশে চলে এসেছে। বাবার মৃত্যুর পর মা কিছুতেই ওদেশ ছেড়ে আসতে চাইলো
না।জমিজমা নেড়েচেড়ে খাওয়াপরা তো জুটে যাবে। এদিকে তিন তিনটে মেয়ে, আমিও বড়ো হয়ে উঠছি, আত্মীয় -স্বজন সবার কথায় মা আমাকে ইণ্ডিয়ায় মাসির কাছে
পাঠিয়ে দিলো। মাসি থাকতেন বজবজে।মেসোর একটা কারখানায় সামান্য চাকরি, মাসির
নিজেরও চারটে সন্তান। আমি আসার পর মাসি কাজের লোক ছাড়িয়ে দিলো সেই জায়গায় আমি বহাল
হলাম।
মঞ্জরী
মিত্র - সেকী মাসীমা আপনার নিজের মাসিতো?
বলাকা
সেন - সারাটা জীবন দিয়ে বুঝেছি নিজের বলে কেউ হয় না গো মেয়ে!আর কপাল যাবে কোথায় -
তুমি যাও বঙ্গে তোমার কপাল যায় সঙ্গে নৈলে মাত্র দশ বছর বয়সে বাবা মারা যাবে কেন
আর মাই বা এক কথায় বোনের সংসারে ভিনদেশে পাঠাবে কেন? আর দুটোকে পালতে পারলে আমিই বা কি এমন ভারি হয়েছিলাম বলো
দিকিনি?
মঞ্জরী
মিত্র - তারপর?
বলাকা
সেন - মাসির বাড়িতে মাস ছয়েক ছিলাম। আমার বাবা যখন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যায়
তখন আমার এক তুতো জ্যাঠার বাড়িতে থাকা-খাওয়ার বদলে তার ছেলেদের পড়াতেন। সেই
জ্যাঠতুতো দাদা জ্ঞাতিদের মুখে খবর পেয়ে আমাকে দেখতে
এসে আমার দুর্গতি দেখে তক্ষুণি আমাকে মাসির কাছ থেকে নিয়ে গেলেন। এবার বজবজ থেকে
গেলাম টালিগঞ্জ এর গ্রাহামস্ ল্যাণ্ড। দাদা আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করলেন। ওখান থেকেই
আমি ম্যাট্রিক পাস করলাম। এই জন্য দাদার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আরো পড়ার
খুব ইচ্ছে ছিলো জানো কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মায়ের চাপ আর কিছুটা জ্যাঠাইমার আমাকে
আর রাখতে না চাওয়া সব মিলিয়ে সাতান্ন সালের মাঘ মাসে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমার
জ্যাঠাইমার বাপের বাড়ির সূত্র ধরেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল ।মা বিয়ের দুদিন আগে
বোনেদের নিয়ে এসে আমার অষ্টমঙ্গলার আগেই ফিরে যায়। এবার আমি টালিগঞ্জ থেকে এলাম
দমদম।
মঞ্জরী
মিত্র- তারপর? বিবাহ পরবর্তী জীবন?
বলাকা
সেন- সে আমলে যেমন হতো। শ্বশুর-শাশুড়ি এক বালবিধবা পিসশাশুড়ি আর পাঁচ জন দেওর
ননদ নিয়ে দশ জনের উপচোনো সংসার। রোজগেরে বলতে আমার স্বামী আর বড়ো দেওর।ভিটে হারা -
দেশহারা হাজার হাজার উদ্বাস্তু পরিবারের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে লড়াই আর শেষ পর্যন্ত
থিতু হওয়ার গল্প, সবই এক। এরপর
শাশুড়ির সন্তান দের মানুষ করতে করতে আর নিজের সন্তান দের জন্ম দিতে দিতে প্রথম দশ
বছর কেমন করে কেটে গেছে টেরও পাইনি। তবে সেই টালমাটাল অভাবের দিনেও আমি খুব
শান্তিতে ছিলাম জানো,সবসময়
ঠাঁই নাড়া হবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকার থেকে তো মুক্তি পেয়েছিলাম, আমার নিজের সংসার - আমার স্বামী - আমার সন্তান - সব আমার! পায়ের তলায় একটু শক্ত
মাটি,
মাথার উপর ছাদ আর কি চাই বলো ভালো থাকার জন্য?
মঞ্জরী
মিত্র- মেসোমশাই কি করতেন মাসিমা?
বলাকা
সেন- যখন বিয়ে হয় তখন কলেজ স্ট্রীটে সেন
ব্রাদার্স এর বই এর দোকানে কাজ করতেন।ওরা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হতেন,সেই সুবাদে চাকরি একটা জুটে যায় কিন্তু এতোবড় সংসার তাতে কি
চলে মা?
তবে খুবই উদ্যমী পুরুষ ছিলেন আমার স্বামী। ওখানে কাজ করতে
করতেই প্রকাশনার লোকজনের সঙ্গে আলাপ হয় তারপর আস্তে আস্তে বই-এর দোকানের চাকরি ছেড়ে ছাপাখানায় কাজ নেন, সেখান থেকে নিজের প্রকাশনা শুরু করেন। তারপর আর পেছন ফিরে
তাকাতে হয় নি। দমদম ছাতাকলের দরমার বস্তি থেকে এই কলকাতা শহরেই দু'খানা বাড়ি করেছিলেন।এক জীবনে সৎ পথে থেকে কোথা থেকে কোথায়
পৌঁছে গেছিলো মানুষটা। সব রূপকথার গল্প মনে হয়।
মঞ্জরী মিত্র- সেখান থেকে এই বৃদ্ধাশ্রম সে পথ ও তো কম অবিশ্বাস্য নয় মাসিমা। আপনার সন্তানদের কথা কিছু বলুন।
বলাকা
সেন- আমার দুই মেয়ে। বড়ো শ্রীতমা-ছোট রূপমা।দুই মেয়েই বাবার রূপ পেয়েছিলো। আমার মতো
কালো না। ফুটফুটে ফর্সা, লম্বা, টানা টানা চোখ। পড়াশোনায় আহামরি না হলেও দুজনেই মাস্টার
ডিগ্রী করেছিলো।শাশুড়ির চাপাচাপি তে এম.এ. পরীক্ষার পরপরই বড়ো মেয়ের বিয়ে দিলাম। জামাই সরকারি চাকুরে,স্বচ্ছল অবস্থা। কোথাও কিচ্ছু না হঠাৎ বিয়ের মাস ছয়েক পর
কোমর এর যন্ত্রণা। মাত্র তেইশ বছর বয়স তখন মেয়ের। প্রচুর ডাক্তার বদ্যি, ভেলোরে ন'মাস
পড়ে থাকলাম মেয়েকে নিয়ে। আস্তে আস্তে দাঁড়ানোও বন্ধ হয়ে গেল। এক এক করে সমস্ত অঙ্গ
নষ্ট হতে লাগলো,মোটর নিউরো
ডিজিনারেশন- নার্ভের দুরারোগ্য রোগে মাত্র আঠাশ বছর বয়সে দূর্গাষ্টমীর সন্ধ্যায়
আমার প্রতিমা বিসর্জন হয়ে গেলো। আমার সাতচল্লিশ বছর বয়সে আমি প্রথম সন্তান হারালাম। আমার স্বামী এ শোক সহ্য
করতে পারলেন না দুবছরের মধ্যে সেরিব্রাল অ্যাটাকে চলে গেলেন। ততদিনে ছোট মেয়ের ও
বিয়ে হয়ে গেছে। সে ইস্কুল টিচার ছিলো। এক ছেলে-এক মেয়ে নিয়ে ভরা ভরন্ত সংসার। সবই
ঠিক চললে এ আর আমার জীবন হবে কেন! বাবার সুগার
ছিল,বাবার রূপের সঙ্গে
সঙ্গে রোগও পেয়েছিল।তিরিশ বছর বয়সে সুগার ধরা পরে আটচল্লিশ এ এসে কিডনি নষ্ট হলো
বছর দুয়েক ডায়ালিসিস চলার পর পঞ্চাশ এ এসে সব শেষ।
মঞ্জরী
মিত্র - মাসীমা অন্য কথায় আসি,আচ্ছা
আপনার বিয়ের পর আর বাপের বাড়ির সঙ্গে
যোগাযোগ হয় নি?
বলাকা
সেন- হয়েছে তো। একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়।বিয়ের পর প্রায় চোদ্দ বছর একটা
চিঠির যোগাযোগ ও ছিলো না - বেড়াল পার করার মতো আমাকে বর্ডার পার করা হয়েছিল,যুদ্ধের সময়
রানাঘাটের এক জ্ঞাতি ভাই এর মারফত আমার মা জামাই-এর প্রকাশনার দপ্তরে যোগাযোগ করে।তোমার মেসোমশাই
প্রকাশনার সূত্রে অনেক বড়োবড়ো লোকেদের চিনতেন।শুনেছি গৌরকিশোর ঘোষ - বরুন সেনগুপ্ত আর সব কাদের ধরে
বেনাপোল বর্ডার থেকে মা আর ছোট বোনকে আনার ব্যবস্থা করেন। ততদিনে আমার পরের বোন
চৈতালীর বিয়েও হয়ে গেছে।ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন
সেসময় আসামে চলে যায়, আমি
এ জীবনে আর কখনও সেই বোনকে দেখিনি। ছোট বোনের বিয়ে তোমার মেসোমশাই দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিলেন।উত্তরবঙ্গের
কোন কলেজের অধ্যাপক জামাই।আমার দুই বোনই বাবার মতো পড়াশোনায় ভালো ছিল, দুজনেই সেই আমলে বি.এ পাশ করেছিল,আমাকে ছুঁড়ে ফেললেও ওদের কিন্তু ঠিকঠাক মানুষ করেছিলো মা।
মঞ্জরী
মিত্র- মাসীমা বেশ বুঝতে পারছি এতো বছর পরেও আপনার কিন্তু মায়ের ওপর বেশ অভিমান
আছে।
বলাকা
সেন - নারে মা অভিমান আর কি! আসলে আমার জীবন তো শুধু 'আছে' থেকে 'নেই' - হয়ে
যাওয়ার গল্প।সুস্থ সবল বাবার হঠাৎ নেই হয়ে যাওয়ায় আমার একলার জীবনই তো তছনছ হলো -
রাতারাতি সর্বহারা হলাম।বাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা দেশ- একটা পরিবার-পরিচয়-শৈশব সব হারালাম।বিয়ের পর কটা বছরের বিরতি আবার তো শুরু হলো খোয়ানোর
পালা। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল আবার সেখানেই ফেরত এসেছি।
মঞ্জরী
মিত্র- মাসীমা একটা শেষ প্রশ্ন। মাতৃদিবসের এই বিশেষ সংখ্যা নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের
সঙ্গে যোগাযোগ করতে ওরাই আপনার নাম সাজেস্ট করেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে ওদের কাছে
আপনার সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য পেয়েছি তাতে জানলাম আপনার একটি পুত্র সন্তানও আছে এবং
সে-ই আপনাকে এখানে দিয়ে গেছে। যদি কিছু মনে না করেন, তার কথাতো কিছু বললেন না।
বলাকা
সেন - আমি বিশ্বাস করি মৃত মানুষের মতো মৃত সম্পর্কও একটা সম্মান দাবি করে। যারা এই
পৃথিবীতে নেই কিন্তু একদিন ছিল- আমার জীবন জুড়ে ছিল আমি সেই থাকার সময় টুকুর
স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। যারা বেঁচে থেকেও আমার পৃথিবীতে নেই তারা তো নেই,একদমই নেই- জীবনেও নেই- স্মৃতিতেও নেই। তাই ভালোবাসা- ঘৃণা কিচ্ছুটি নেই। একদম আমি মুছে
ফেলেছি।কিন্তু আমার মাকে মুছবো কি করে? তার জন্য আমার এক সমুদ্দুর অভিমান আছে আবার এক আকাশ ঋণও
আছে যে। মা এর হাত ধরেই পৃথিবীর মুখ দেখেছি, মায়ের দুধের ঋন কি শোধ হয় রে মা,তাই প্রতিদিন অভিমানের ফুল দিয়ে তাকে স্মরণ করি কিন্তু
সন্তান এর কাছে মায়ের কোনো ঋণ থাকেনা, ছেলের জন্য আমি তাই কিচ্ছু রাখিনি-কিচ্ছু না-বিস্মৃতি
ছাড়া।
*গল্পে ব্যবহৃত ছবিটি www.shutterstock.com থেকে সংগৃহীত
দারুন দিদিভাই!সর্বহারা মায়ের ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী!
উত্তরমুছুনউফফফ...
উত্তরমুছুন