শিল্পী চিত্তপ্রসাদ: আমাদের অনাদর, আমাদের উপেক্ষা
ষাট বছরেরও কিছু অধিককাল বেঁচে ছিলেন
চিত্তপ্রসাদ। আদর্শহীনতা আর আপসকামিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক জীবন্ত ভাষা হয়ে
আছে চিত্তপ্রসাদের গোটা জীবনচর্চা। শিল্প সৃষ্টি আত্মার শান্তি আর চিত্তের আরাম
ছিল তাঁর কাছে। জীবনের নানান ঝড়-ঝাপটা-সংঘাত আর পরস্পরবিরোধী নানান টানাপোড়েনের
মধ্যেও ইস্পাতকঠিন তাঁর শিল্পীব্যক্তিত্বের স্পর্ধা আকাশ স্পর্শ করেছিল যেমন, তেমনি অর্থলোলুপতা এসে তাঁর পায়ের নীচের শক্ত মাটিকে টলিয়ে দিতে পারেনি
এতটুকুও। এমনি এক শিল্পী-স্রষ্টার চরিত্র চিত্রায়ণে বিখ্যাত জলরঙের শিল্পী গোপাল
ঘোষ মন্তব্য করেন, "চিত্ত হলো আগুনের স্ফুলিঙ্গ।
এরকম প্রতিভা এক-আধটা আসে। সহজে চিত্ত জন্মায় না।" 'চিত্তপ্রসাদ' নামে একটি অসাধারণ কবিতায় কবি রণজিৎ
সিংহ লেখেন তাঁর সেই অবিস্মরণীয় পঙক্তিমালা: "মাটিতে পা ডুবিয়ে হাজার
বছরের আবর্তনে/শেকড় মেলে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন চিত্তপ্রসাদ।"
কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে সাম্যবাদী-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে এক
আপসহীন মানসিক দৃঢ়তা আর আদর্শের শক্ত বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল তাঁর মধ্যে। এই শক্ত
ভিতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর যাবতীয় সৃষ্টিকলা। ভারতবর্ষের শিল্পকলার ইতিহাসে
তিনি হলেন হাতে গোনা কতিপয় সেই শিল্পী-স্রষ্টাদের অন্যতম একজন যেখানে জীবন ও
শিল্প মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল
একসময়। তাঁর সৃষ্টির সামনে দাঁড়ালে বোঝা
যায় স্রষ্টা মানুষটি কেমন। নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা আমাদের দেশের যে গরিষ্ঠ
জনসমাজ, সেই গরিষ্ঠ গণমানুষের জীবন ও ভাষা খোঁজার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল
চিত্তপ্রসাদের যে শিল্পী জীবনের যাত্রা, প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও সেই খোঁজা
শেষ হয়ে যায়নি কখনো। শিশু শ্রমিক, সবজি বিক্রেতা, জেলে, কামার-কুমোর-কৃষক, দিনমজুর-মজুরানি, শ্রমক্লান্ত আর শ্রমদীপ্ত সাধারণ খেটে খাওয়া পুরুষ-নারি ভিড় করে এসেছে তাঁর
ছবির জগতে। সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর আদর্শকেই তিনি রূপ দিয়েছেন তাঁর
চিত্রশিল্পে। সেই আদর্শকে সমাজজীবনে সক্রিয় করে তুলতে জীবনের বহু মূল্যবান সময়
ব্যয় করে গিয়েছেন তিনি। গণমানুষের শিল্পী চিত্তপ্রসাদ এইভাবে এককভাবে গড়ে গিয়েছেন মাটির গন্ধ মাখা ভারতীয় চিত্রকলার এক স্বতন্ত্রধারা।
সারাজীবন কত শিল্পসৃষ্টি করেছিলেন চিত্তপ্রসাদ? এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে একজন শিল্পী-স্রষ্টার সমাদর আর লালন-পালনের ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় চরিত্রের দৈন্যতার চিত্রটি এমন নির্মমভাবে প্রকটিত হয়ে ওঠে যে অবশেষে সেখান থেকে মাথা নিচু করে সরে আসা ছাড়া উপায় থাকে না কোনো। স্বতঃস্ফূর্ত এই শিল্পী-স্রষ্টার হৃদয় নিংড়ানো সৃষ্টির সিংহভাগ অনাদর ও অবহেলায় কালের করাল স্রোতে ভেসে কোথায় চলে গেছে তার খোঁজ পাওয়া যায় না আর। লিনোনিয়াম মাধ্যমে চিত্র রচনা করাটা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতো প্রতিদিনের স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত কাজ ছিল তাঁর। এখানে বিশেষভাবে বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের কথাটা মাথায় রাখা জরুরি, আত্মপ্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে ছাপচিত্রের প্রতি এ দেশের সৃজনশীল শিল্পীরা তেমনভাবে আকর্ষণ বোধ করেননি। অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করবার ক্ষেত্রে আর্থিক অসচ্ছলতা অন্যতম প্রধান কারণ হলেও গভীর এক অন্তর্গত তাগিদেই আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে লিনোনিয়াম নামক সুলভ এই মাধ্যমটিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন চিত্তপ্রসাদ। কারণ তিনি মনে করতেন কোনো প্রদর্শনশালার
মুখাপেক্ষী না থেকে ছাপচিত্র মাধ্যমটির সফল ব্যবহারে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের কাছে।তাই দেখা যায় পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তাঁর ছাপচিত্রের বিপুল বিস্তার ঘটে যায় গোটা ভারতবর্ষেই শুধু নয়, দেশের সীমানা ভেঙে সেই ঢেউ গিয়ে পৌঁছায় দেশের বাইরে ডেনমার্ক,চেকোশ্লোভাকিয়া, জার্মান,নরওয়ে, চীন, আমেরিকায়। শুধুমাত্র চিত্রসৃষ্টিই নয়, চিত্তপ্রসাদের শিল্পীপ্রতিভা মুক্তি পেতে চেয়েছিল বহুমুখী ধারায়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গঠিত 'গণনাট্য সংঘ'-এর 'সেন্ট্রাল স্কোয়াড' বা 'সেন্ট্রাল ট্রুপ'-এর ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের অনেকগুলিতেই মঞ্চস্থাপত্য এবং অঙ্গসজ্জা রূপায়ণেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। গণনাট্য সংঘের প্রতীক চিহ্নটি যে চিত্তপ্রসাদের আঁকা সে কথা যেমন অনেকেরই অজানা, ঠিক তেমনি, গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস রচয়িতাদের রচনায় এই দিকটিতে, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথাও থেকে যায় অনুল্লিখিত। মনে রাখা দরকার এ দেশে রিপর্টাজধর্মী রচনার অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ হলেন চিত্তপ্রসাদ। অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের দুর্ভিক্ষ কবলিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল পায়ে হেঁটে ইংরাজি ভাষায় লেখা ও আঁকা 'হাংরি বেঙ্গল' নামের রিপোর্টাজধর্মী রচনা সংকলনটি মানুষের তৈরি এ বঙ্গের পঞ্চাশের মহামন্বন্তরের জীবন্ত দলিল নয় শুধু, সাহিত্য ও চিত্রমূল্যে যে কোনো দেশের মহাসম্পদও বটে। এই মহাগ্রন্থের প্রায় সবকটিই অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় বৃটিশ সরকার। কোনোমতে বেঁচে যায় মাত্র একটিই। চিত্ত প্রসাদের ছোট বোন গৌরী ভট্টাচার্যের সংগ্রহে থাকা ওই একটি মাত্র কপিই পরবর্তীতে চিত্তপ্রসাদ অনুরাগীদের নজরে আসে। এবং এই বাংলার কয়েক লাখ বাঙালির না খেয়ে মরার এক সকরুণ ইতিহাসের পাতা হাট হয়ে খুলে যায় আমাদের
চোখের সামনে। খুলে দেন চিত্তপ্রসাদ। এদেশের গ্রন্থচিত্রনের এক স্বর্ণযুগের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে চিত্তপ্রসাদের নাম। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রজনী পাম দত্তের বিখ্যাত গ্রন্থ 'ইন্ডিয়া টুডে'-এর একটি সুলভ সংস্করণের জন্য পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি অপ্রচল মাধ্যম স্ক্যাপার বোর্ডে করেন ছাপচিত্র। সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রণীত 'আমার বাংলা' ও 'যখন যেখানে' নামের রিপোর্টাজধর্মী বিখ্যাত গ্রন্থ দুটির জন্যও চিত্র আঁকেন চিত্তপ্রসাদ। সৈনিকদের জীবন নিয়ে রচিত বরেন বসুর বিখ্যাত উপন্যাস 'রংরুট' নামের বিখ্যাত উপন্যাস গ্রন্থটির জন্যও ছবি আঁকেন তিনি। গ্রন্থচিত্রনের পাশাপাশি এসে যায় যায় তাঁর করা পোস্টার চিত্রের কথাও। মনে রাখতে হবে একজন মানবতাবাদী রাজনৈতিক প্রচারক হিসেবে তাঁর শিল্পীজীবন শুরু করেছিলেন চিত্তপ্রসাদ। তাই বহু রাজনৈতিক পোস্টার আঁকতে হয়েছিল তাঁকে। চল্লিশের দশকে এদেশের ফ্যাসিস্ট-বিরোধী বামপন্থী আন্দোলন ও তেভাগা-তেলেঙ্গনা কৃষক আন্দোলনের জন্য তাঁর আঁকা পোস্টার চিত্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাঁর চৌষট্টি বছরের স্বল্প জীবনসীমায় চল্লিশ বছরেরও অধিককাল শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে, অনাদর আর অবহেলাকে সঙ্গী করে, সৃষ্টির এক অনাবিল আনন্দেই কাজ করে গিয়েছেন জীবনভোর। সৃষ্টির এই বাঁধভাঙা ঢেউয়ের পেছনে জাগতিক কোনো চাওয়া- পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল না যেমন, তেমনি ছিল না খ্যাতির সমুদ্রে সাঁতার কেটে অমরত্ব লাভের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা।তাই দেখা যায় স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে, তাঁর একদার বামপন্থী সহযোদ্ধা-সুহৃদরা এক একটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানের চূড়ায় উঠে নিজেরাই যখন হয়ে উঠছেন এক একটি প্রতিষ্ঠান, তখন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর শিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগদানের আহ্বান ফিরিয়ে দিচ্ছেন চিত্তপ্রসাদ। প্রতিষ্ঠান বিরোধী শক্ত মেরুদণ্ডের অকৃতদার, চিরকালীন বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী চিত্তপ্রসাদ কংগ্রেসি প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই না ভিড়ে মুম্বাইয়ের আন্ধেরির শ্রমিকবহুল অঞ্চলের তাঁর সেই ছোট্ট ঘরটিতে ছবি, পুতুলনাচের পুতুল, অভাব,অনটন, উপবাস, রোগভোগ আর অদম্য জেদের সঙ্গে অনমনীয় আদর্শবোধকে সঙ্গী করে আমৃত্যু রয়ে গেলেন। বিদেশ যাবার আহ্বান এসেছে বহুবার। সে আহ্বানও ফিরিয়ে দিয়েছেন চিত্তপ্রসাদ।
মুখাপেক্ষী না থেকে ছাপচিত্র মাধ্যমটির সফল ব্যবহারে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের কাছে।তাই দেখা যায় পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তাঁর ছাপচিত্রের বিপুল বিস্তার ঘটে যায় গোটা ভারতবর্ষেই শুধু নয়, দেশের সীমানা ভেঙে সেই ঢেউ গিয়ে পৌঁছায় দেশের বাইরে ডেনমার্ক,চেকোশ্লোভাকিয়া, জার্মান,নরওয়ে, চীন, আমেরিকায়। শুধুমাত্র চিত্রসৃষ্টিই নয়, চিত্তপ্রসাদের শিল্পীপ্রতিভা মুক্তি পেতে চেয়েছিল বহুমুখী ধারায়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গঠিত 'গণনাট্য সংঘ'-এর 'সেন্ট্রাল স্কোয়াড' বা 'সেন্ট্রাল ট্রুপ'-এর ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের অনেকগুলিতেই মঞ্চস্থাপত্য এবং অঙ্গসজ্জা রূপায়ণেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। গণনাট্য সংঘের প্রতীক চিহ্নটি যে চিত্তপ্রসাদের আঁকা সে কথা যেমন অনেকেরই অজানা, ঠিক তেমনি, গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস রচয়িতাদের রচনায় এই দিকটিতে, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথাও থেকে যায় অনুল্লিখিত। মনে রাখা দরকার এ দেশে রিপর্টাজধর্মী রচনার অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ হলেন চিত্তপ্রসাদ। অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের দুর্ভিক্ষ কবলিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল পায়ে হেঁটে ইংরাজি ভাষায় লেখা ও আঁকা 'হাংরি বেঙ্গল' নামের রিপোর্টাজধর্মী রচনা সংকলনটি মানুষের তৈরি এ বঙ্গের পঞ্চাশের মহামন্বন্তরের জীবন্ত দলিল নয় শুধু, সাহিত্য ও চিত্রমূল্যে যে কোনো দেশের মহাসম্পদও বটে। এই মহাগ্রন্থের প্রায় সবকটিই অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় বৃটিশ সরকার। কোনোমতে বেঁচে যায় মাত্র একটিই। চিত্ত প্রসাদের ছোট বোন গৌরী ভট্টাচার্যের সংগ্রহে থাকা ওই একটি মাত্র কপিই পরবর্তীতে চিত্তপ্রসাদ অনুরাগীদের নজরে আসে। এবং এই বাংলার কয়েক লাখ বাঙালির না খেয়ে মরার এক সকরুণ ইতিহাসের পাতা হাট হয়ে খুলে যায় আমাদের
চোখের সামনে। খুলে দেন চিত্তপ্রসাদ। এদেশের গ্রন্থচিত্রনের এক স্বর্ণযুগের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে চিত্তপ্রসাদের নাম। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রজনী পাম দত্তের বিখ্যাত গ্রন্থ 'ইন্ডিয়া টুডে'-এর একটি সুলভ সংস্করণের জন্য পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি অপ্রচল মাধ্যম স্ক্যাপার বোর্ডে করেন ছাপচিত্র। সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রণীত 'আমার বাংলা' ও 'যখন যেখানে' নামের রিপোর্টাজধর্মী বিখ্যাত গ্রন্থ দুটির জন্যও চিত্র আঁকেন চিত্তপ্রসাদ। সৈনিকদের জীবন নিয়ে রচিত বরেন বসুর বিখ্যাত উপন্যাস 'রংরুট' নামের বিখ্যাত উপন্যাস গ্রন্থটির জন্যও ছবি আঁকেন তিনি। গ্রন্থচিত্রনের পাশাপাশি এসে যায় যায় তাঁর করা পোস্টার চিত্রের কথাও। মনে রাখতে হবে একজন মানবতাবাদী রাজনৈতিক প্রচারক হিসেবে তাঁর শিল্পীজীবন শুরু করেছিলেন চিত্তপ্রসাদ। তাই বহু রাজনৈতিক পোস্টার আঁকতে হয়েছিল তাঁকে। চল্লিশের দশকে এদেশের ফ্যাসিস্ট-বিরোধী বামপন্থী আন্দোলন ও তেভাগা-তেলেঙ্গনা কৃষক আন্দোলনের জন্য তাঁর আঁকা পোস্টার চিত্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাঁর চৌষট্টি বছরের স্বল্প জীবনসীমায় চল্লিশ বছরেরও অধিককাল শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে, অনাদর আর অবহেলাকে সঙ্গী করে, সৃষ্টির এক অনাবিল আনন্দেই কাজ করে গিয়েছেন জীবনভোর। সৃষ্টির এই বাঁধভাঙা ঢেউয়ের পেছনে জাগতিক কোনো চাওয়া- পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল না যেমন, তেমনি ছিল না খ্যাতির সমুদ্রে সাঁতার কেটে অমরত্ব লাভের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা।তাই দেখা যায় স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে, তাঁর একদার বামপন্থী সহযোদ্ধা-সুহৃদরা এক একটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানের চূড়ায় উঠে নিজেরাই যখন হয়ে উঠছেন এক একটি প্রতিষ্ঠান, তখন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর শিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগদানের আহ্বান ফিরিয়ে দিচ্ছেন চিত্তপ্রসাদ। প্রতিষ্ঠান বিরোধী শক্ত মেরুদণ্ডের অকৃতদার, চিরকালীন বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী চিত্তপ্রসাদ কংগ্রেসি প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই না ভিড়ে মুম্বাইয়ের আন্ধেরির শ্রমিকবহুল অঞ্চলের তাঁর সেই ছোট্ট ঘরটিতে ছবি, পুতুলনাচের পুতুল, অভাব,অনটন, উপবাস, রোগভোগ আর অদম্য জেদের সঙ্গে অনমনীয় আদর্শবোধকে সঙ্গী করে আমৃত্যু রয়ে গেলেন। বিদেশ যাবার আহ্বান এসেছে বহুবার। সে আহ্বানও ফিরিয়ে দিয়েছেন চিত্তপ্রসাদ।
ভাতা চল্লিশ টাকা নেওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর, আমৃত্যু, রনোমত্ত পৃথিবীতে নিজেকে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন। শুরু হয়, আমৃত্যু,আর্থিক কৃচ্ছতার সঙ্গে মাথার উপর থেকে ছাদ হারাবার আশঙ্কা,নিজ গৃহভূমি উচ্ছেদের হুমকি আর ভীতি। তাঁর বাড়ির বিদ্যুৎ ও জল বন্ধ করে দেওয়া হয়। নীরব সাক্ষী থেকে, এমন একটি নির্মম কাজে মদত দিয়েছেন নেতাসম সর্দার পৃথ্বী সিং। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী , চিত্তপ্রসাদ সুহৃদ অবনীরঞ্জন রায় জানাচ্ছেন, "যাঁরা চিত্তপ্রসাদকে পার্টিতে নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে সর্দার পৃথ্বী সিং-এর বাড়িতেই তো তিনি ছিলেন। সর্দার পৃথ্বী সিং তাঁর সঙ্গে তো কুকুর বিড়ালের মতো ব্যবহার করেছেন। দুবেলা তাঁকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছে। " চরম আর্থিক অনিশ্চয়তা আর মাথার উপর থেকে ছাদ হারাবার আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তায়, অবশেষে, অসুস্থ- শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন চিত্তপ্রসাদ। উনিশশো আটাত্তরের মে মাসের সাতেরো তারিখে বাড়ির সিঁড়ির লাগোয়া বাথরুমে যেতে গিয়ে পা পিছলে চিত্ত প্রসাদের উরুর হাড় ভেঙে যায়। চিত্তপ্রসাদের কনিষ্ঠা ভগিনী গৌরী ভট্টাচার্য এবং আন্ধেরির প্রতিবেশীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্য তাঁর উপর আক্রমণ করা হয়। তাঁর বাড়ি ছাড়ার আগেই বাড়িটি হস্তান্তর হয়ে গিয়ে বহুতল নির্মানের উদ্দেশ্যে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হয়ে যায়। চরম আর্থিক ক্লেশ, শারীরিকনানান বেতরতা আর বুক ফাটা কান্না নিয়ে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের মুম্বাইয়ের প্রিয় আবাস রুবি টেরাসের বাড়ি ছেড়ে উনিশ আটাত্তরের জুলাই মাসে বরাবরের মতো কলকাতায় চলে এলেন চিত্তপ্রসাদ। ওই বছরের নভেম্বরের তেরো তারিখে তিনি মারা যান। অকৃতদার , নিঃসঙ্গ আর উদাসীন এই শিল্পীর মৃত্যকালে বয়স হয়েছিল তেষট্টি বছর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের আগমনকে ঘিরে উত্তেজনায় কম্পিত কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহল ও সাধারণের কাছে তুলনায় গুরুত্বহীন ছিল এই মৃত্যু সংবাদ। এ দেশের কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ এই রকম একজন শিল্পী মানুষের মৃত্যুতে
উদাসীন আর নির্লিপ্ত ছিল কলকাতার বামপন্থী মহল। এই নিবন্ধকারের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চিত্তপ্রসাদ সুহৃদ খালেদ চৌধুরী জানিয়েছেন, "হাসপাতালের বেড থেকে চিত্তপ্রসাদের মরদেহ বাইরে বের করা হল। প্রায় গোটা পঞ্চাশেক ফোন করলাম। সিপিআই, সিপিএম অফিস, যাদের সঙ্গে চিত্তপ্রসাদ যুক্ত ছিলেন। ফোনে যোগাযোগ করলাম। কেউ কোন সাড়া দিল না।" শ্মশান যাত্রী হিসেবে চিত্তপ্রসাদের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী ছিলেন কবিবন্ধু সমর সেন, গোলাম কুদ্দুস, খালেদ চৌধুরী, অবনীরঞ্জন রায় ও ভাস্করবন্ধু প্রভাস সেন প্রমুখ বিশিষ্টজন। উপেক্ষা আর অনাদরের এরকম বহু দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে চিত্তপ্রসাদের গোটা জীবনময়। আমৃত্যু চরম কৃচ্ছতার মধ্যেও তাঁর মেরুদণ্ড বেঁকে যায়নি একবিন্দুও। এভাবেই গনগনে লাল তরল আগুনের ভিতর দিয়েই গোটা জীবনভর হেঁটে বেরিয়েছেন চিত্তপ্রসাদ। এই আগুনে পুড়েই মজবুত আর ঝকঝকে ধারালো হয়ে উঠেছিল চিত্তপ্রসাদের হাতিয়ার। আমৃত্যু সঙ্গী সেই হাতিয়ার হল রঙতুলি আর তাঁর বিশাল হৃদয়। বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের আগুন পরস্পর বাসা বেঁধে যেখানে আমৃত্যু বসবাস করেছিল।
* প্রবন্ধে ব্যবহৃত ছবিগুলি চিত্তপ্রসাদের আঁকা।
Khub Sundar Lekha. Tathya babul. Abhinandan
উত্তরমুছুনচিত্তপ্রসাদ কে আজকের প্রজন্ম কতটা chene?
উত্তরমুছুনলেখক ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
উত্তরমুছুনচিত্তপ্রসাদকে আজকের প্রজন্ম জানে...
উত্তরমুছুনমর্মস্পর্শী লেখা। বিশ্বাসের ভিত যেন কেঁপে গেল।
উত্তরমুছুনপ্রকাশ দাসকে অনুরোধ এরকম বিরল প্রতিভা চিত্র শিল্পীদের নিয়ে আরো লেখা চাই।
উত্তরমুছুনবিষয় ভাবনা ভাল। সঙ্গে তথ্য সূত্র দিলে ভাল হত।
উত্তরমুছুন