ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য : বিধান চন্দ্র রায়







ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘অন্তঃশীলা’, ‘আবর্ত’, ‘মোহনা’

মার্ক্সবাদের অন্তঃক্ষরণ ও বহিঃক্ষরণ

বুদ্ধি দিয়ে সমাজ সংস্কৃতি ও ব্যাক্তিত্বকে বিশ্লেষণ করতেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকার প্রভাব। সেই ঋণ স্বীকারও করেছেন ধূর্জটিপ্রসাদ। “১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেসটো আর ১৯২২ সালে মার্ক্সের ক্যাপিটাল পড়ার মধ্য দিয়ে ধূর্জটিপ্রসাদের মনোজগতের পরিবর্তনের সূচনা।”১ ‘সবুজ পত্র’ ‘উত্তরা’তে লেখালেখি করলেও তিনি ছিলেন প্রধানত ‘পরিচয়’ পত্রিকার লেখক। এই পত্রিকার পুস্তক পরিচয় অংশটি মূলত তিনিই দেখতেন। এই ‘পরিচয়’ পত্রিকার আড্ডা বসত প্রতি শুক্রবার। এই আড্ডায় ‘সবুজ পত্র’, ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর লেখকরা যেমন ছিলেন তেমনি কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। “বস্তুত, ১৯৩৬ সাল থেকেই ‘পরিচয়’এর আড্ডা দারুনভাবে জমে ওঠে। এর পূর্বে ‘পরিচয়’ এর আড্ডায় বা ‘পরিচয়’ এর পৃষ্ঠায় যে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সমাজনীতি, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে কিংবা পাশ্চাত্য জড়বিজ্ঞান বা মার্ক্সবাদ সম্পর্কে আলোচনা হত না তা নয় কিন্তু বামপন্থী প্রগতিশীলতা বলতে যা বোঝায় তার সূচনা ‘পরিচয় পত্রিকায় ঘটেছিল তিরিশের দশকের ঠিক মধ্যপর্ব থেকে।২ “বামপন্থী প্রগতিশীলতার বিস্তার ঘটেছিল নিরন্তর মার্ক্সবাদ চর্চার মাধ্যমে। আর মার্ক্সবাদ চর্চার ব্যাপারে অন্যতমদের অগ্রগন্য যে মানুষটি, তিনি ধূর্জটিপ্রসাদ। “ডক্টর ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত বাদে এদেশে রীতিমত মার্ক্সবাদ অধ্যয়ন ও আলোচনা ধূর্জটিবাবুর আগে কে করেছিলেন জানি না।“৩ ‘ভাবগঙ্গার ঘোলাটে জলে লালের আভা’৪ বিস্তার করেছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ধূর্জটিপ্রসাদ। তবে মার্ক্সবাদী বলতে যা বোঝায় ধূর্জটিপ্রসাদ তা ছিলেন না। তিনি মুক্ত মণ নিয়ে কোন বিষয়কে যুক্তি দিয়ে গ্রহন ও বর্জন করতেন তাই কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য দেখানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। “নিজেকে Marxologist বলা চলে। ভারতবর্ষে সে বস্তু বিরল, তাই আমিও বিরল। “৫তবে মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবর্ষীয় সমাজ ও সংস্কৃতির আলোচনা করেছেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে, ধূর্জটিপ্রসাদের ‘অন্তঃশীলা’ প্রকাশিত হয়। ঐ বছরের শেষের দিকে ‘আবর্ত’ ও ‘মোহনা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪১-১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে, ‘পরিচয়’ পত্রিকাতেই। এই ট্রিলজিতে ধরা পড়েছে খগেনবাবু নামে এক নায়ক চরিত্রের ক্রমবিকাশ। ক্রমবিকাশের স্তরে থাকে পরিণতি।একজন মার্ক্সীয় তাত্বিক যখন সংস্কৃতি ও সমাজের আধার ও আধেয়গত সম্পর্ক লক্ষ্য করেন এবং সামাজিক মানুষকেও যখন বিশ্লেষণ করেন মার্ক্সীয় মাপকাঠিতে তখন তার পরিণতিও যে অমার্ক্সীয় হবেনা তা সহজেই অনুমেয়।আর পরিণতি যদি মার্ক্সীয় হয়, তাহলে সূচনা স্তর মার্ক্সীয় ভাবনাতেই গাঁথা হয়। ‘অন্তঃশীলা’ উপন্যাসে একজন গ্রন্থকীট বুদ্ধিজীবীর নেতিবাচক আত্মবিশ্লেশন ও তাঁর অস্থিরচিত্তের পরিচয় পাই। তারই পরিণতি ঘটেছে মার্ক্সীয় কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ক্রমবিকাশের স্তরে পারম্পর্য না থাকলে পরিণতি আরোপিত বলে মনে হয়। তাহলে ‘মোহনা’য় খগেনবাবুর যে রূপান্তর তা কি আরোপিত? হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন উল্লম্ফন? না, ‘অন্তঃশীলা’ অংশেই তার বীজ নিহিত।

‘অন্তঃশীলা’ উপন্যাসের ভূমিকায় ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন “অন্তঃশীলা’ আমি ভাবের বসে লিখিনি। এর মধ্যে না আছে আত্মকথা, না আছে ভাবগত প্রেরণা। অথচ খুঁটিনাটি ঘটনার পিছনে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ছিল। সে সব অভিজ্ঞতা চিন্তার ভিতর দিয়েই চালুই হয়ে এসেছে। এবং মন যখন প্রধানত লেখকের তখন লেখকের মনভঙ্গি ও ভাষা কিছু পরিমানে তার সৃষ্ট চরিত্রের সাথে মিল খাবে। আমার মন খগেনবাবুকে ধার দিয়েছি মাত্র”।

‘অন্তঃশীলা’র কাহিনি অংশে আমরা পেলাম, স্ত্রী সাবিত্রীর স্থূল চিন্তাধারা, কৃত্রিম শৌখিনতা, যুক্তি বিবর্জিত অভিমান, জেদ খগেনবাবুর মতো ইন্টেলেকচুয়ালকে ব্যথিত করত। সাবিত্রীর আত্মহত্যা খগেনবাবুকে উপরিউক্ত জট থেকে মুক্তি দেয়। সাবিত্রীর বান্ধবী রমলার অপেক্ষাকৃত ইন্টেলেকচুয়াল বিউটি খগেনবাবুকে আকৃষ্ট করে। সাবিত্রীহীন জীবনে রমলার প্রেমও দ্বিধাদন্দময়  খগেনবাবুর জীবনে সেরকম আলোড়ন ‘অন্তঃশীলা’ স্তরে তৈরি হয়নি।চরম অতৃপ্তি নিয়ে কলকাতা ত্যাগ আর কাশী অভিমুখী যাত্রায় ‘অন্তঃশীলা’ কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

‘এককের আত্মমগ্নতা’য় খগেনবাবু স্বাধীনতা খুঁজতে চেয়েছেন। সমাজকে অস্বীকার করে যে স্বাধীনতা খুঁজতে চাওয়া, মার্কসীয় বিচার পদ্ধতিতে তা অবান্তর। মানুষ এই স্বাধীনতার মধ্যে একটা বিপন্নতা অনুভব করে। খণ্ড চৈতন্যের মায়াজালে আবদ্ধ সেই মানুষ বাইরের জগতের সঙ্গে সহযোগ স্থাপন করতে পারে না। এটাই বিযুক্তি। ইংরাজিতে যাকে বলা হয় Alienation। কার্ল মার্কস Economic and Philosophic Manuscript of 1844-এ এই Alienationনিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। “ A direct consequence of man’s alienation from the product of his labour, from his life activity, from his species-being, is the alienation of man from man when man confront himself, he confront another man”শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মার্কস এঙ্গেলস এই বিযুক্তিকে লক্ষ্য করেছিলেন। শ্রম, সমাজ, স্বয়ং থেকে যে বিযুক্তি বা বিচ্ছিন্নতা, আর তা থেকেই জন্ম নেয় খণ্ডচৈতন্য আত্মমগ্নতা। মানুষ বিচ্ছিন্ন কিন্তু সে সেই বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি অনুসন্ধানী। সে খোঁজে সহযোগ। আর একের সঙ্গে আরের সহযোগেই মানুষের মুক্তি আসে। খগেনবাবু এই বিচ্ছিন্নতা বা বিযুক্তির উদাহরণ। আবার একই সঙ্গে সহযোগ অনুসন্ধানীও বটে। তাই তার ইতিবাচক পরিণতি লক্ষ্য করা গেছে।

ধূর্জটিপ্রসাদ যে খগেনবাবুকে বিচ্ছিন্ন করে দেখিয়েছেন সেখানে কাজ করেছে তাঁর সচেতন অভিপ্রায়। কিরকম বিষয়টি? একটু দেখা যাক। খগেনবাবু চিঠিতে রমলাকে জানাচ্ছেন, “আমি স্ত্রী জাতিকে ঘৃণা করিনা। তাদের কাছে আমি বেশি প্রত্যাশা করি, পাইনা, তাই ক্ষোভ হয়, ক্ষোভে রাগ, রাগে ঘৃণা।”৮ খগেনবাবু কি প্রত্যাশা করেন স্ত্রী জাতির কাছে? সে প্রত্যাশা সাবিত্রীর কাছে প্রাথমিকভাবে, পরবর্তীতে রমলার কাছে। সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনা, অকৃত্রিম শৌখিনতা, যা সাবিত্রীর ছিলনা। সাবিত্রীকে ঐ দাবি যদি মেটাতে হত, তাহলে সেটাও হত এক ধরনের ‘মারজিনালাইজেসান’। সমাজে আর পাঁচজন যেমন ঠিক তেমন নয়, একটু আলাদা। অর্থাৎ সে ও বিচ্ছিন্ন, বিযুক্ত অর্থাৎ alienate from society। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে যা চরম সত্য। আর সাবিত্রী আর পাঁচজন নারীর মতোই প্রচলিত সমাজ ধারায় লালিত পালিত। যাঁরা বাপের বাড়ির সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির সহযোগ নির্মাণ করে। নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ে তলে অর্থাৎ একধরনের সহযোগের সহবস্থান নির্মাণ করে। কিন্তু খগেনবাবুর বিচ্ছিন্নতা, আত্মমগ্নতা সেই সহযোগকে আমল দেয় না। তাই সাবিত্রীকে আত্মঘাতী হতে হয়। এই ঘটনা অবশ্যই মার্কসবাদ সম্মত বলেই মনে করি। খগেনবাবুর কথায় আরও স্পষ্ট হয় বিষয়টা, “আমার বিরোধটা কি? সাবিত্রী আমাকে সঙ্কুচিত করে আনছিল, সে চাইত যে আমি কেবল স্বামী হয়েই থাকি, স্বামীত্বেই যেন আমি নিঃশেষিত হই। তাছাড়া সমাজও তাকে সাহায্য করছিল। দুই চাপের মাঝখানে আমি কমঠবৃত্তি অবলম্বন করলাম, আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হলাম। আমার অর্থকষ্ট ছিল না বলে সমাজকে অন্তত অবহেলা করতে পেরেছি...সাবিত্রীর তাগিদ ও চাহিদা থেকে উদ্ধার পেলাম বই-এর পাতায়। কর্মপ্রবৃত্তি অবরুদ্ধ হলে মানুষ বুদ্ধিজীবী হয়।”এখানে আমরা দুটি বিষয় পেলাম, পয়সা থাকলে সমাজকে অবহেলা করা যায়। অর্থাৎ এই সমাজ ভঙ্গুর। এই সমাজেই রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’- এর নায়িকা কুমুদিনীকে কাঁদিয়েছিল, ‘চোখের বালি’-র বিনোদিনীকে সমাজ স্বীকৃতি না দিয়ে কাশী পাঠিয়েছিল। এই সমাজেই ‘মালঞ্চ’-এ সরলা ও ‘দুইবোন’ ঊর্মিমালার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। পাঠকের এই সমাজের ওপর রাগ হয়, এই সমাজের গঠনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পুরুষশাসিত বুর্জোয়া সমাজ নারীকে অবহেলা করে, এতো মার্কসবাদ সম্মত। খগেনবাবুও সেই বুর্জোয়া সমাজেরই বুদ্ধিজীবী। 'আন্তঃশীলা' উপন্যাসটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকালে রচিত। তাই এই সময়ের সংকট বিশেষত, বুদ্ধিজীবী সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। তারা বিচ্ছিন্ন , তাই আত্মসচেতন। এই আত্মসচেতনতায় ধরা পড়ে এক শূন্যতাবোধ। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ দাশের 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'তে আমারা লক্ষ্য করেছি এই শূন্যতা-
"স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়
তারে আমি পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে
সব কাজ তুচ্ছ হয়- পন্ড মনে হয়
সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয়।"১০

এই বিচ্ছিন্নতাবোধ স্থায়ী হয়নি। এর ইতিবাচক উত্তরণ ঘটেছিল। যদিও "মার্কস বাখ্যায়িত বাস্তব সমাজের পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের ধারা ও নিয়মের , পুঁজিতন্ত্রের অবক্ষয়ের শেষে মানবমুক্তির অনিবার্যতায় তিনি (জীবনানন্দ দাশ) দোদুল্যমান ছিলেন।১১ তবু তো তিনিই অনুভব করেছিলেন "রণ রক্ত সফলতা সত্য/তবু শেষ সত্য নয়"১২ "সুচেতনা এই পথেই আলো জ্বেলে , এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে১৩। "খগেনবাবু এরকম এক ইতিবাচক পরিণতির মাধ্যমে পূর্ণতা চান। সাবিত্রীর সঙ্গে সংসারে সুখ নেই। বাইরের ঘাত- প্রতিঘাতময় জীবনপ্রবাহ , সেখানে শান্তি নেই, আবার তিনি বলেছেন "মিষ্টিসিজম- এর সাধনায় নিজেকে ভেঙে গড়তে হয়, তা আমি পারবো না।১৪ "দৈহিক সুখকেও ‌‌‌‌খগেনবাবু ক্ষনিকের মনে করেন। তিনি বলেছেন- "দৈহিক সুখ নিচু স্তরের। দেহকে ঘৃনা করি না, কিন্তু ঐ প্রকারের ক্ষনিকের সুখের দ্বারা মহাকালের গন্ডি অতিক্রম করা সম্ভব নয়।"১৫ ধূর্জটিপ্রসাদ পরিকল্পনামাফিক খগেনবাবুকে নির্মাণ করেছেন। খগেনবাবু একসময় পয়সার জোরে সমাজ নিষেধকে অগ্রাহ্য করেছিলেন এবং বইয়ের পাতায় মুক্তি খুঁজছিলেন, তখন আমরা খগেনবাবু সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলাম যে, খগেনবাবু alienate from the society। এই স্তরে খগেনবাবু individual কিন্তু এই খগেনবাবু 'অন্তঃশীলা' অংশেই সমাজের জন্য আক্ষেপ করেছেন- "আমার সমাজ নেই। নিজের উপর কর্তব্যকে কর্তব্য বলে না। তাছাড়া সমাজও যদি থাকে তবু স্বরাট না হলে পরের উপর কর্তব্য কিংবা দশের উপকার করব কি করে ? আগে গোটা মানুষ হই, তারপর সব হবে।১৬ " মার্কস সঙ্গত কারণেই বলেছেন "Individual existence is at the same time of social being।১৭" খগেনবাবু গোটা মানুষ হতে চাইছেন, চাইছেন মহাকালের গন্ডি অতিক্রম করতে। ধূর্জটিপ্রসাদের অভিপ্রায় খগেনবাবুকে 'individual' থেকে 'person'-এ উন্নীত করা। এই personality-ই হলো 'গোটা মানুষ','বড় আমি'। ব্যক্তি কে অতিক্রম করে সমবেত সত্তায় মিলিত হতে চাইছেন খগেনবাবু। তার কথাতেই তা স্পষ্ট " সম্বন্ধ সৃষ্টি যদি জীবন হয়, তাহলে আমার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রইল না ত! সমবেত জীবনকে অগ্রাহ্য করে এসেছি, অগ্রাহ্য কেন ঘৃনাই করেছি। একত্র সৃষ্টি করার আনন্দেই যে জীবন পুষ্ট হয় বুঝিনি। সম্বন্ধেই আনন্দ।" এই স্তরে খগেনবাবু বিযুক্তি ছেড়ে সহযোগের দিকে যাচ্ছেন। 'অন্তঃশিলা'-র এরূপ ইঙ্গিত তো মার্কসবাদ সম্মত। কিন্ত person এ পরিণত করা অথবা সমবেত সত্তায় মিলিত হবার ইচ্ছাপ্রকাশ অন্তঃশীলা স্তরে ঠিকই, কিন্ত এটা ক্রমবিকাশের স্তরের প্রথম ধাপ। 'আবর্ত' অংশের ভূমিকায় ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন.... "খগেনবাবু উপলব্ধি করলেন, অন্তঃশীল প্রবাহকে বহির্মুখী না করলে আবর্ত্তের সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী। আবর্ত্ত ইতিমধ্যের অবস্থা, বিরোধের আলোড়ন, সন্ধিক্ষণের সক্রিয় নিশ্চয়তা।এবং ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে ব্যক্তিগত জীবন ঘূর্ণায়মান।"১৯

 এই স্তরে আমরা দেখলাম, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর দোলাচল চিত্তের আরেকটা দিক। হরিদ্বারে সাধুসঙ্গে তাঁর মন ভরেনি। সেখানেও একপ্রকার বিপন্নতা   অনুভব করেছেন। ফিরে এসেছেন রমলার টানে কাশীতে। দৈহিক সম্পর্কে মিলিত হয়েছেন রমলার সঙ্গে। মাসিমার মৃত্যু, খগেনবাবুকে মাসিমার রক্ষণশীলতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই আবর্তপর্বে সরাসরি সোশিয়ালিজম-এর স্বপক্ষে বক্তব্যকে হাজির করেছেন খগেনবাবু। সুজনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সমাজবাদের বিভিন্ন দিক। এই অংশেই খগেনবাবুর অনুভূতিতে ধরা পড়েছে - "সোশালিজম চলার ধর্ম, এই যুগের ধর্ম এই অর্থে যে, সেটি বর্তমানে অন্তর্নিহিত। সেই সঙ্গে আগত প্রায় নতুন সমাজ রচনার ধৃতিতত্ত্ব।"20 খগেনবাবু  ক্রমশ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন - " নিজ! নিজ? একটা ছোট আমি আছে, তাতে নেই। বড় আমি একাধিকের মধ্যে বহুর অন্তরে। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রের সীমা পার না হলে, মিথ্যা শক্তির মোহ কাটে না, প্রকৃত শক্তির মোহ কাটে না, প্রকৃত শক্তির আস্বাদ পাওয়া যায় না।" ২১ 'আবর্ত' অংশে আমরা তিনটে দিক পাই - এক. মাসিমার স্নেহের টান; দুই. রমলার ভালোবাসা; তিন. মতাদর্শে বিশ্বাস। 'আবর্ত' পর্বেই মাসিমার মৃত্যু ঘটেছে, রমলার বিসর্পিল প্রেম ক্রমশ শিথিল হয়ে গেছে, অবশিষ্ট থাকে সমাজবাদে আস্থাশীলতা। আমরা সেটাই 'মোহানা' স্তরে পূর্ন হতে দেখব।

'মোহনা' অংশে কাহিনিতে আমরা পাই, মাসিমার মৃত্যুর পর খগেনবাবু, রমলা দেবী কাশীর পাট চুকিয়ে কানপুরে চলে আসেন এবং একত্রে বাস শুরু করেন। আত্মমগ্ন পুঁথির জগত থেকে কিছুটা বিদায় নিয়ে খগেনবাবু অনেকটা মাটির কাছাকাছি আসেন।কানপুরে, লখ্নৌতে চলা শ্রমিক ধর্মঘটকে খগেনবাবু প্রত্যক্ষ করেছেন, বা দৈনন্দিন বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছেন। পরে খগেনবাবু শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গেছেন। শ্রমিক নেতা সফিকদের সঙ্গে নানান তর্ক-বিতর্কে অংশ নিয়েছেন খগেনবাবু। তিনি অনুভব করেছেন সাম্য চিন্তা শুধু তত্ত্ব আবদ্ধ দর্শন নয়, তা অনুশীলন সাপেক্ষ, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে তার প্রয়োগ চাই।শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া সম্বলিত ড্রাফট তৈরি করা, রাজনৈতিক কারণে সফিককে  গ্রেফতার করলে খগেনবাবু লখ্নৌতে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, এইভাবেই খগেনবাবু কমিউনিস্ট কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। আর রমলাদেবী শৌখিন পুরুষসঙ্গ নিয়ে ভেসে গেছে গড্ডালিকা প্রবাহে।

'মোহানা' অংশে খগেনবাবু শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতা প্রসঙ্গ অনুধাবন করেছেন, এতদিন কোন দল বা পার্টির প্রয়োজনীয়তায় খগেনবাবুর বিশ্বাস ছিল না। সফিকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় খগেনবাবু পার্টির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছেন। বিজনের বিচ্যুতিও যে মার্কসবাদ সম্মত তাও তিনি অনুভব করেছেন।অর্থাৎ পরিপূর্ণ মার্কসীয়  চরিত্র হিসেবে প্রস্তুত করার কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।

একটা প্রশ্ন মনে আসে এই প্রসঙ্গে, ধূর্জটিপ্রসাদ খগেনবাবুকে কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করাতে কানপুরে নিয়ে গেলেন কেন? শুধুই কি ধূর্জটিপ্রসাদের কর্মক্ষেত্র বলে? বিষয়টি সেরকম নয় বলেই মনে হয়। দীর্ঘ সময় খগেনবাবু যুক্তপ্রদেশে কাটিয়েছেন ঠিকই, লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, যুক্তপ্রদেশ সরকারের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। সামনে থেকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেছেন ঠিকই, কিন্তু এর থেকে আরও কিছু বিষয় আমাদের ইঙ্গিত করে। যেমন, বাংলার লড়াই আন্দোলনের সাথে কানপুরের তুলনা করে বলেছেন - "বাঙালি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ফ্যাশিজমের বীজ রয়েছে। কিন্তু যুক্তপ্রদেশ আজ প্রগতিশীল। কানপুরের ধর্মঘট, উনাওয়ের ধাওয়া, মীরাটের মেথর সমস্যা,গোরখপুর জেলার মহারাজগঞ্জের কৃষক আন্দোলন,যার তুলনা ফ্রান্সের 1789 সালের পূর্বের প্রাদেশিক আন্দোলনে পাওয়া যায়।এ দেশ জাগছে, সত্যি জাগছে।"

 আবার অন‍্যতম শ্রমিক নেতা উধমজি বলেছেন- "রুশ বিপ্লবে যেমন মস্কোর স্থান, ভারতীয় বিপ্লবে তেমনি কানপুরের।" এছাড়া ভারতের মাটিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় 1925 খ্রিস্টাব্দে, কানপুরেই। সেই অর্থে বলা যায় মধ্যবিত্ত ভারতীয় বুদ্ধিজীবী,প্রাত্যহিকতার জট থেকে, স্বার্থপরতা ও শৌখিনভাব বিলাসের জগত থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা মুক্তি খুঁজেছে বামপন্থায়। কানপুরকে সেই মুক্তির একটি প্রতীক বলে মনে করা হয়। যেমন ভার্জিনিয়া উলফ্ -এর 'লাইট হাউস'; যা প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্নবিন্দু।

 উল্লেখপঞ্জী
১. সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ; 'বিশশতক' অলোক রায়; প্রমা কলকাতা-73, পৃষ্ঠা-121।
২. প্রগতি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কয়েকটি সাময়িকপত্রের ভূমিকা 'সুস্নাত দাস । বাংলা সংস্কৃতিতে মার্কসবাদী চেতনার ধারা। ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত; অনুষ্টুপ, কলকাতা, পৃষ্ঠা-426।
৩.'পরিচয়ের কুড়ি বছর ও অন্যান্য স্মৃতিচিত্র'; হিরণ কুমার সান‍্যাল; প্যাপিরাস, কলকাতা,1978, পৃষ্ঠা-87।
৪.ঐ
৫.'ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী' তৃতীয় খন্ড, 'ঝিলিমিলি'; দেজ্ 1987, পৃষ্ঠা-218।
৬. ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী/1; পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-421
৭. Economic and philosophic manuscript of 1844’. Karl Marx. ‘The portable Karl Marx edited by Eugne Kamenka, Penguine Books, 1983. পৃষ্ঠা-140.
৮. ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী/1; অন্তঃশীলা পৃষ্ঠা-154
৯. ঐ-পৃষ্ঠা-172.
১০. 'বোধ'- 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' জীবনানন্দ দাশ, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভারবি, কলকাতা-2005
১১. হৃদয়ের শব্দহীন জ‍্যোৎস্নার ভিতর, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পত্রভারতী, কলকাতা-1997, পৃষ্ঠা-39.
১২. 'সুচেতনা', 'বনলতা সেন', জীবনানন্দ দাশ, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভারবি, কলকাতা-2005, পৃষ্ঠা-52
১৩. ঐ
১৪. ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী/1; দেজ্ পাবলিকেশন্, 2002, 'অন্তঃশীলা' পৃষ্ঠা-179
১৫. ঐ; পৃষ্ঠা-179.
১৬. ঐ; পৃষ্ঠা-179.
১৭. Economic and philosophic manuscript of 1844'. Karl Marx. 'Progress Publication,Moscow,1959.
১৮. ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী/1; দেজ্ পাবলিকেশন্, 2002, পৃষ্ঠা-180.
১৯. ঐ, পৃষ্ঠা-433
২০. ঐ, পৃষ্ঠা-264
২১. ঐ, পৃষ্ঠা-265
২২. ঐ, পৃষ্ঠা-314
২৩. ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী/1; দেজ্ পাবলিকেশন্, 2002, কলকাতা।

*ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।


২টি মন্তব্য:

  1. গবেষণা মূলক এই লেখাটি দরকারি লেখা... লেখকে অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন
  2. তথ্যসমৃদ্ধ এই লেখাটি অনবদ্য। লেখককে অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com