ভাস্কর
চক্রবর্তীর কবিতা: নাগরিক
জীবনের সাতকাহন কথা
বিশ
শতকের ছ'য়ের দশকের বাংলা কবিতায় অন্যতম নাম ভাস্কর চক্রবর্তী (১৯৪৫-২০০৫)।
পশ্চিমবঙ্গের এক অস্থির সময়পর্বে 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা ' কাব্যগ্রন্থ নিয়ে
বাংলা কবিতায় ভাস্কর চক্রবর্তীর আবির্ভাব। ওপার বাংলায় তখন মুক্তিযুদ্ধের
দামামা, কোলকাতার রাস্তা-ঘাট প্রায়ই যুবক ও তরুণদের রক্তাক্ত মৃতদেহ বহন করে
চলেছে, নকশাল বাড়ি আন্দোলন ক্রমশ তীব্রতর রূপ ধারণ করে চলেছে, কবির বসত বরানগরে
ঘটল রাজনৈতিক হত্যালীলা - এমত সময়ে কবি চিলেকোঠার ঘরে ভয় ও ঘৃণাকে সঙ্গী করে প্রতিবাদের
ভাষা তৈরি করলেন কবিতায়। সমস্ত ঘৃণা-ভয়-ক্রোধ কবি তুলে রাখলেন তাদের জন্যে যারা
রক্তের হোলি খেলায় মত্ত-
কিন্তু বিস্ময় ও আবেগে শহর কোলকাতার জন্য জমিয়ে রাখলেন যাবতীয় প্রেম।
পূর্বপুরুষেরা ওপার বাংলার মানুষ হলেও, ভাস্কর চক্রবর্তীর নাড়ির টান তৈরি হল কোলকাতার
সঙ্গে। উত্তর কোলকাতার দর্জিপাড়ার এক নার্সিং হোমে কবির জন্ম; দু'বছর পর থেকে
আজীবন বরানগরের বাসিন্দা। বরানগরের বাসিন্দা হলেও কবির আত্মিক টান ছিল সমগ্র
কোলকাতা শহর ও শহরতলী জায়গাগুলোর সঙ্গে। কবি একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমার
কবিতায় যেসব গলির কথা এসেছে, প্রথমেই জানাই তা শুধু উত্তর কোলকাতার নয়। সারা
কোলকাতার গলি গুলো আমাকে টানে"-কবির
এই ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনকে ঘিরে প্রবাহিত হয়েছে তা নয়
বরং কবির অনেক কবিতার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে কোলকাতার মিশ্র জনজীবন,
রাস্তাঘাট, রেঁস্তোরা, আলো-অন্ধকার, সর্বোপরি এই শহরকে ঘিরে কবির ফ্যাশিন্যাশন।
বাংলা
কবিতা জগতে ভাস্কর পূর্ববর্তী সময়ে বাংলা কবিতার উল্লেখযোগ্য নাগরিক কবি হিসেবে পরিচিত
ছিলেন কবি সমর সেন। ভাস্কর চক্রবর্তী এই ধারার যোগ্য উত্তরসূরীত্ব বহন করেন। মহানগরী
কলকাতার সঙ্গে ভাস্করের সম্পর্ক অনেকটা প্রেমিকার মতো যার সাথে অভিমান হয়, রাগ হয়
আবার দিনের শেষে ভাবও হয়। কবির একেবারে গোড়ার কাব্য থেকে শুরু করে শেষ কাব্যগ্রন্থ
পর্যন্ত নাগরিক জীবনবোধের প্রকাশ সাযুজ্য নিয়ে ফুটে উঠেছে। কোলকাতার গলি- সরু রাস্তার
প্রতি প্রেম কবি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'র কবিতাগুলির মধ্য
দিয়েই পাঠকের কাছে হাজির করেছেন। কবি লেখেন-
"সারা
বছর কলকাতার প্রত্যেকটা গলি, কানাগলি ঘুরে বেড়িয়েছি আমি"
আর
এই ভবঘুরের মতো শহর পরিক্রমা কেবলই নিজের খেয়াল মেটানোর জন্য নয় কখনো সখনো সে
খেয়ালে মিশে গেছে সাধারণের ভাবনাটুকুও ---
"তোমাদের
কথা, দেয়ালে - দেয়ালে লিখে রাখতে ইচ্ছে করে কলকাতায়"
জীবনের
সঠিক প্রস্তুতির সময়েই সঙ্গ-নিঃসঙ্গতায় শহর কলকাতা কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কাছে ধরা
দিয়েছে নির্ভরতা নিয়ে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কবি আস্থা রেখেছেন শহরের শান্ত বলয়ে-
"জানি না আমি, আজ সন্ধেবেলা কী ভেঙ্গে পড়বে আকাশ থেকে-
মোটরগাড়ি, ল্যাম্প-পোস্টের ভেতর দিয়ে
দেখি, কলকাতার দিকে চলে গেল- আমাকেও ঐ-রকম
কলকাতার দিকে চলে যেতে দাও- ছাব্বিশ বছর শেষ
হতে চলল আমার"
প্রথম যৌবনের কোলকাতা, কবির কাছে ধরা দিয়েছে বালখিল্য
প্রেমের ভালোলাগায়। দশ বছর পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে এসে সেই প্রেম পরিণত হয়েছে,
আবেগের সাথে মর্মে এসে জড়িয়ে ধরেছে শহরের নতুন রূপ। বদলে যাওয়া কোলকাতার ছবিটিও
স্পষ্ট করলেন কবিতায়, সাক্ষী থাকলেন শহরের বুকে বেড়ে ওঠা নতুন নতুন সম্পর্কের- "...যখন ছিল শুধুই ঘুরে-
বেড়ানোর দিন, আমি দেখতাম, দোতলা-বাস সাঁতার কেটে ছুটে চলেছে কলকাতায়- পার্কে,
রেস্তোরাঁয়, ভেসে বেড়াচ্ছে ছেলেমেয়েরা আর চুমু খাচ্ছে একে অপরকে।" কোলকাতার
ট্রাম, কুয়াশা ঘেরা ময়দান কবিকে নিয়ে যায় শহর সম্পর্কে অন্য এক আচ্ছন্নময়তার বোধে।
শহর প্রেমে আচ্ছন্ন কবি একা, নিঃসঙ্গ, শহরই শুধু প্রেমিকার মত দাঁড়াতে পারে পাশে-
"হে প্রিয় শহর, তুমি চিঠি কেন লেখো
না প্রত্যহ?
একা একা একা একা, কেঁপে উঠি, মানুষের দেশে।"
কখনো
সখনো কবির নিঃসঙ্গ যৌবনের পাশে শহরও নিঝুম, নিঃশব্দ। কবির মৃত্যুবোধের কাছে শহরও যেন
আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে কোন অন্ধকার খোঁজ করে চলেছে। নগর কলকাতার সর্বত্র শুধু ঝাঁ-চকচকে
জীবন রয়েছে, --- এ চরম সত্য নয় বলেই ভাস্কর চক্রবর্তী সতেরো তলার হোটেলের পাশে বস্তিকে
পাশাপাশি রেখে খোঁজ করলেন নাগরিক জীবনের হৈ-হুল্লোড়ময় জীবন পাশাপাশি বস্তির অন্ধকারে
বেঁচে থাকা নরকীয় জীবনের সংলাপ-
"সতেরো- তলার হোটেল না বস্তিতে। এই আলপিন
ভর্তি কলকাতায় তুমি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছো কি?"
কলকাতা
শহরের ট্রাম, মিনিবাস, অলি-গলিতে কবি খুঁজে পান আপন দেবতার খেয়ালী চাল-চলন। এই দেবতাই
কবির নিভৃত গোপনের খোঁজ রাখে, আবার কবিও এই দেবতা দ্বারা পরিচালিত। কবি ও দেবতার সমান্তরাল
অবস্থান --- শহরের যাবতীয় ভাবনার বশবর্তী হয়ে এক সময় একই বিন্দুতে এসে মিলে যায়।
দেবতা হয়ে দাঁড়ায় কবির জীবনবোধ, আর কবি হয়ে দাঁড়ান দেবতার নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এই
দেবতার সান্নিধ্যে এসে প্রথম ভাস্কর চক্রবর্তী কোলকাতা ছেড়ে একটু সুদূরে পাড়ি দিতে
চাইলেন --- দূরত্ব বাড়াতে চাইলেন ঠিক কিন্তু বিষয় থাকল সেই এক, নাগরিক জীবনের মাঝে
নিজেকে নিরন্তর খুঁজে চলা-
"বড়িশা যাদবপুরে কেন? চলো বরোদায় গিয়ে
বাতাসে সাঁতার কাটি-
উল্টোপাল্টা
লোকের মতন
লাফাই সবুজ মাঠে,"
কখনো
শহরের বুকে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে কবি কূল-কিনারা না পেয়ে শহরের নাম দেন দুশ্চিন্তানগরী।
কোলকাতা দুশ্চিন্তা নগরী হয়ে চেপে বসলেই কবির বুকে বাজে অভিমানের বাঁশি, দেয়ালার মতো
চোখের সামনে ফুটে ওঠে শহরের বুকে একদিন ঘটে যাওয়া রক্তস্রোত, কাটামুন্ডুর নড়ে-চড়ে
ওঠা। এ সময় কবি শহরের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ করে ওঠেন-
"আমার শহর আজো
জুয়াড়ির হাসির মতন।"
তবুও
দিনের শেষে শহরের আবর্তে মিশে গিয়ে কবি ভালোবাসেন কোলকাতা শহরের নতুন নতুন সব বাহানা।
জুয়াড়ির হাসির মতন শহর তখন বদলে গিয়ে; শান্ত সমাহিত এক মহিয়সী রমণীর সস্নেহ দু'হাত
দিয়ে জড়িয়ে রাখে নাগরিক জীবনের সমস্ত ক্লেদ, ক্লান্তি, ব্যথা, ঘুম আর অপার ভালোবাসা।
আর শহরের বুকে কবিও বাঁচেন সেরকমই স্বপ্নময়তার বিভঙ্গে-
"আমি বাঁচি...
শুধু দু-একটা স্নেহ দু-একটা হাত
শুধু দু-একটা হাসির জন্য"
ভাস্কর
চক্রবর্তীর সমগ্র কাব্যভুবনে শহর কোলকাতা অনেক অংশ জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে
উঠে এসেছে। শ্যামবাজার, ভবানীপুর, বরানগর, বি.টি. রোড-এর মতো সমস্ত স্থানিক নামও ভাস্করের
কবিতায় অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে। কলকাতা শহর ও শহরতলির অংশগুলি বাদ দিলে খুব কম এসেছে
অন্য শহরের নাম। বেনারস, ব্যাঙ্গালোর, পাঁশকুড়া, পুরুলিয়া- এইসব শহর
ও মফঃস্বল শহরের কথা সমস্ত কবিতা জীবনে দু-একবার করে উচ্চারিত হয়েছে, বাকীটা জুড়ে
কেবলই কোলকাতা- যা
কবির নিঃসঙ্গ ভাবনার নিশ্চিন্ত আশ্রয়। কোলকাতা কোনদিন কবিকে ভুলে যাক তা তিনি কখনোই
চাননি, ফলত ভয় ছিল তাঁর-
"কলকাতা এবার ঠিক আমাকেই
ভুলে যাবে
ভাবি তবু সুপ্রভাত কাছে
ডাকবে- পুরুলিয়া বলবে চলে এসো।"
পুরুলিয়া চলে আসতে বললেও
কবি কিন্তু আস্থা রেখেছেন অন্যতর কলকাতায়-
"এবার কলকাতা ছেড়ে চলে যাবো অন্য এক
শান্ত কলকাতায়"
কবিকে
কাছে যারা দেখেছেন তারাও জানেন কবির কোলকাতা শহরের প্রতি প্রেম-ভালোলাগা- অভিমানের
তীব্রতা। এখনো অনেক কবি তাঁদের কবিতার মধ্য দিয়ে খোঁজেন ভাস্করের অস্তিত্বকে আর যার
বৃত্তে রয়েছে শহর কোলকাতার কল্লোলিনী তিলোত্তমা রূপ-
"তোমাকে দেখেছে কত বরানগরের রাস্তাঘাট
তোমাকে দেখেছে কত কলেজস্ট্রিটের অলিগলি
তোমাকে দেখেছে হাডকো মোড়"
সবশেষে
'শহরের প্রেত' কবির আবদারই শহরের সবচেয়ে বড়ো অলংকার হয়ে ওঠে। কোলকাতা প্রেমী মানুষজনদের
নতুন করে শহর নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে ভাস্করের কবিতা, যেমন একদিন ভাস্করও ছিলো শহরের
রাখাল, কোলকাতার বাধ্য ছাত্র-
"আমার সেই ভালোবাসার শহরের ভেতর দিয়ে, এক সুগন্ধের ভেতর দিয়ে, আমি এখন বাড়ি
ফিরছি। কলেজস্ট্রিট থেকে শ্যামবাজারের দিকে একা একাই হেঁটে চলেছি আমি"। আর ভাস্করের এই নিরন্তর হেঁটে চলা
কখনো শেষ হবে না, যতদিন গর্বিত কোলকাতা বেঁচে থাকবে, যতদিন বেঁচে থাকবে বাংলা কবিতা,
ঠিক ততদিন পাঠক মনে রাখবে ভাস্করকে, ভাস্করের শহর প্রেমকে।
* ভাস্কর চক্রবর্তীর ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
* ভাস্কর চক্রবর্তীর ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
কবিকে গলি থেকে রাজপথে আনার এই প্রয়াস প্রশংসনীয়।
উত্তরমুছুন