চাবি
ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে
বেশ খানিকটা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ধীমান। ধীমান ভট্টাচার্য, বি. কম। বাড়ি ব্যান্ডেল।
ইংরিজিতে চোস্ত নয়। আর এখানেই আটকে গেছে সব। বাংলা মাধ্যমের স্কুল থেকে পড়ে আসা ছেলেরা
জিডি শুরু করার আগেই সব শেষ করে দেয় ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা। ওদের আর কিছু বলার
থাকে না। সেই ধারের সামনে তারা যে নেহাতই ম্যাড়ম্যাড়ে তা বোঝে ধীমান। কিন্তু, তবু আশা
মরে না। এবার যদি শিকে ছেঁড়ে। এই নিয়ে এ মাসে ৩ বার কলকাতায় আসতে হল তাকে। ঘনঘন কলকাতা
যাতায়াতে মানিব্যাগেও টান পড়ছে। ইন্টারভিউর জন্য আজও টিউশনিটায় যাওয়া হবে না। ছাত্রীর
বাবা আগের দিনই একটু বাঁকা কথা শুনিয়েছে। 'সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এত কামাই কেন স্যর?
মেয়েটার সিলেবাস শেষ হবে তো?'
এমনভাবে বলল, যেন
মেয়ের ক্যারিয়ার নিয়ে কত ভাবনা। এদিকে ক্লাস এইটের মেয়ে অঙ্ক না বুঝলেও এখনই প্রেমিক
আনকাউন্টেবল। এসব ভাবলেও মাথা গরম করে না ধীমান। এই মেয়েকে পড়ানোর জন্য ১,২০০ টাকা
পায় সে। জানে, ওর কিছু হওয়ার নেই। স্রেফ বাপের টাকা নষ্ট। তা যাক গে! ইটভাটা আর বালির
ব্যবসা। ওদের অনেক টাকা।
এসব ভাবনা আপাতত
সরিয়ে রেখে একটা চায়ের দোকানের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ধীমান। এখনও হাতে খানিকটা
সময় আছে। সল্টলেকের এই জায়গাটায় কোনওদিন আসেনি সে। অফিসটাও ঠিক কোন জায়গায় বুঝতে পারছে
না। রিশেপনিস্ট মিষ্টি গলায় বলেছিল, 'লোকেশন বুঝতে না পারলে ফোন করবেন'। কিন্তু, ময়দানে
নেমে ঠিকানা তো ধীমানকেই খুঁজতে হচ্ছে। আর বারবার ফোন করে ব্যালান্সও নষ্ট করা যাবে
না। দেখা যাক দোকানদার যদি চা-সিগারেটের বদলে ঠিকানা বলে দেয়।
এক ভাঁড় চা নিয়ে
চুমুক দিতে দিতে ধীমান মাঝে মাঝে সিগারেটের ধোঁয়া উগরে দিচ্ছিল। স্টলের গায়ে ঝোলানো
কালচে আয়নাটায় নিজেকে আগ্নেয়গিরির মুখ হিসেবেই ভাবছিল। ‘দাদা কি ইন্টারভিউ দিতে?’ ধীমানের
ভাবনায় পর্দা ফেলে দিয়েছিল দোকানির প্রশ্ন। ততক্ষণে ঠিকানা জানা হয়ে গেছে। তাই, ‘হ্যাঁ’
বলে ঝামেলা হঠাতে চাইছিল ধীমান। কিন্তু, দোকানদার নাছোড়বান্দা। ‘সে আপনাকে দেখেই বোঝা
যাচ্ছে।’ বলেই মুচকি হাসল সে। উত্তর শুনে নিজেই নিজের দিকে একবার তাকিয়ে নিল ধীমান৷
ইস্ত্রি করা জামা, প্যান্ট। পায়ে কালো জুতো। সব তো ঠিকই আছে। সমস্যাটা কোথায়?
এ বার দোকানদারের
দিকে নজর গেল ধীমানের। তার গায়ে আধময়লা হাফ চেক জামা আর লুঙ্গি। জামার প্রথম বোতামটা
খোলা। সেখানে থিকথিকে ময়লা কলারের প্রান্তটা ক্লান্ত হয়ে ঝুলে পড়েছে। গলায় লোকনাথ বাবার
লকেট। গায়ের রং তামাটে। মাঝারি উচ্চতা। বাঁ গালে একটা গোল গর্ত। ক্ষত অনেক পুরনো। বয়স
ষাটের ওপরেই হবে বলে মনে হল তার।
ধীমানের দৃষ্টির
সামনে অবশ্য দোকানির মাথা তখন নোয়ানো। ‘আমার কাছে একটা জিনিস আছে। সব পরীক্ষা পাসের
ওই একটিই চাবি।’ বিড়বিড় করে বলে দোকানদার। প্রথমে কান না দিলেও, ‘চাবি’ শব্দটা ধাক্কা
মারে ধীমানের মাথায়। ‘জিনিসটা কি? মাদুলি–টাদুলি? আমি কিন্তু ওসবে বিশ্বাস করি না।
ওসবে পয়সা নষ্ট করার বান্দা আমি নই।’ উত্তর শুনে আধহাত জিভ কেটে ফেলে দোকানদার। দু’পাশে
মাথা নেড়ে বলে, ‘আরে ভাই, ওসব কিছু নয়। কিন্তু, হেব্বি কাজের। সঙ্গে রেখে দিলেই বুকে
সাহস থাকে। পকেটও গরম থাকে। আর সব প্রশ্নের উত্তর ওই একটাই। একসময় আমি ওই চাবি অনেক
কাজে লাগিয়েছি। এখন আর ইচ্ছে করে না। তাছাড়া বয়সও হচ্ছে। যদি রাজি থাক তাহলদ ওটা সস্তাতেই
দিয়ে দেব।’ টাকা–পয়সার কথা শুনে খানিকটা থমকে যায় ধীমান। লোকটা চোর–ছ্যাঁচোড় নয়তো?
সন্দেহটা বুকে ধাক্কা মারে তার। সন্দেহের উত্তর দোকানি নিজেই দিয়ে দেয়, ‘ভয় পেয়ো না,
এসো আমার সঙ্গে।’ এই বলেই হাঁটা জুড়ে দেয় সে। ইচ্ছে না থাকলেও, পিছু নেয় ধীমানও। হাতে
খানিকটা সময় আছে বটে। কিন্তু, কোনও ঝামেলায় পড়বে না তো! "তা দাম কিরকম দিতে হবে?"
যেতে যেতেই প্রশ্নটা করেই বসে ধীমান। সাবধানের মার নেই। চারদিকে যেরকম ঠগ জোচ্চোর বাড়ছে!
-"চিন্তা কোরো না ভাই, একদম জলের দামে দেব। আমি আর ওটা রেখেই বা করবো কি? বয়সও
হল।...তবে হ্যাঁ এককালে ওই চাবি প্রচুর ঘুরিয়েছি। একদম হাতেনাতে কাজ। কত কিছু ম্যাজিক
হয়েছে, কী বলব। তোমার তো মোটে একখান চাকরিই দরকার!"
ধীমান দেখল, লোকটা
অনেক বকবক করলেও আসল ব্যাপারটা কিছুতেই খোলসা করছে না। মাদুলি নয়, তাবিজ, কবচ নয়। তাহলে
জিনিসটা কী? কি আর করা যায়। ধৈর্য তাকে ধরতে হবেই! বেশ খানিকটা গিয়ে একটা ঝুপড়ির মধ্যে
ঢুকে পড়ে দোকানি। একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে, বুক পকেট থেকে বের করে ফেলে চাবি। তালা
খুলে ফেলে সে। ধীমানের দিকে ফিরে বলে, ‘আসুন, ভেতরে আসুন' আচমকা আসুন সম্বোধনে একটু
চমকে ওঠে ধীমান। এতক্ষণ তুমি তো ঠিকই ছিল। হঠাৎ এত খাতির কেন? দোকানদার ততক্ষণে ঘরের
আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। কম পাওয়ার। তবে ঘরের অন্ধকারটা সঙ্গে সঙ্গে সরে যায়। একটা চেয়ারও
ধীমানের দিকে এগিয়ে দেয় দোকানদার। তারপর চৌকির তলা থেকে ঘষড়ে বের করে একটা টিনের তোরঙ্গ।
মেঝেয় লোহা ঘষটানোর আওয়াজে দাঁত শিরশির করে ওঠে ধীমানের! দোকানি ততক্ষণে তোরঙ্গর ডালা
খুলে ফেলেছে। ওপরের কাপড়চোপড় সরিয়ে সে হাতে তুলে নিয়েছে জিনিসটা। জিনিসটার ইস্পাত–কালো
রঙয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ তখন কপালে উঠেছে ধীমানের।
দোকানি তখন বিড়বিড়
করে বলে চলেছে, ‘সি জেড ৭৫, সেমি অটোম্যাটিক পিস্তল। ওজন এককেজির একটু বেশি। বুলেট
৯ মিলিমিটার। এফেক্টিভ রেঞ্জ ৫০ মিটার, মানে, টেবিলের এপার থেকে খুব সহজেই নাগাল মিলবে
ওপারের। আর দাম? স্মার্ট ফোনের চেয়েও কম।’
ছবিঃ অর্ণব নন্দী
ছবিঃ অর্ণব নন্দী
চমৎকার।শেষটা দারুন।
উত্তরমুছুনদারুন।
উত্তরমুছুনগল্পের শেষটা অদ্ভুত জায়গায় এনে ফেলল।
উত্তরমুছুন