গত শতাব্দীর আশির
দশক থেকে বিশ্বজুড়ে সাবলটার্ন বা নিম্নবর্গীয়দের নিয়ে নানা তাত্ত্বিক আলোড়ন উঠে। বাঙালি
ইতিহাসবিদরা তথা সমাজতাত্ত্বিকেরা এই তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন।
এদেরে মূল বক্তব্য ছিল, সময় ও তার নির্মাণের পিছনে যে ঔপনিবেশিক ভাষ্য, তা থেকে উত্তীর্ণ
হওয়ার প্রচেষ্টা। তাদের নির্মিত ডিসকোর্সে নিম্নবর্গীয়দের আখ্যান প্রাধান্য লাভ করেছিল।
বাংলা সাহিত্য সমালোচকদের এই নব ডিসকোর্স ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল প্রান্তিক
জাতিকে; প্রান্তীয় সীমানা থেকে না দেখে, অপরায়নের অন্ধকারে না রেখে তাদের নিজস্ব
হৃদস্পন্দনকে তুলে ধরা। এই প্রচেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন রূপায়ন বাংলা সাহিত্যে দেখা
গেছে। ড. বিকাশ চন্দ্র বাগদির লেখা “বাংলা সাহিত্যে বাগদি সমাজ’’ নামক বইটিতে এই
রকমই একটি রূপায়ন গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে। যদিও তিনি কোন তাত্ত্বিক প্রসঙ্গকে সেভাবে
উল্লেখ করেননি তার গবেষণা গ্রন্থটিতে। ড. বিকাশ চন্দ্র বাগদি বাংলা সাহিত্যে বাগদি
সমাজের কথা তুলে ধরেছেন। ড. বাগদি নিজে এই জাতির মানুষ হওয়াতে এই জাতির সাংস্কৃতিক
পরম্পরার যে বিবর্তন, ক্রমাগত সময় ও ইতিহাসের যে আধিপত্য সেই জাতির উপর নেমে
এসেছে, তা অনুভব করেছেন। সেই অনুভবের বাস্তবায়িত রূপ তিনি দেখতে পেয়েছেন বাংলা
সাহিত্যের মধ্যে। ঔপনিবেশিক ও আধাসামন্ততান্ত্রিক সমাজে, এমনকি স্বাধীনতা লাভের
পরেও সেই জাতিকে কীভাবে দেখা হয়েছে, মূলত অ-বাগদি জাতির লেখকদের চোখে-তাকেই তিনি
লিপিবদ্ধ করেছেন আলোচ্য গ্রন্থটিতে। একইসঙ্গে বাগদি জাতির যে স্বাভাবিক যাপন,
তাদের চাওয়া পাওয়ার যে মানবিক পাঁচালি, বীরত্ব ও শোষণের যে দ্বান্দ্বিক আবহ-সেগুলো
সাহিতিক্যদের কলমে কীভাবে উঠে এসেছে, সে প্রসঙ্গ তিনি বলেন। আলোচ্য বইটির মধ্যে
তিনি পাঠককে প্রথমে পরিচয় করিয়েছেন বাগদি জাতির উৎপত্তি ও বিবর্তন; যেখানে মিশে
রয়েছে একদিকে নৃতাত্ত্বিক অন্যদিকে সমাজতাত্ত্বিক পরিচয়। তারপর সেই জাতির সামাজিক
ও সাংস্কৃতিক নানা দিক। এরপর বাগদি জাতি বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ, লোকসাহিত্য ও
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে কীভাবে বিবর্তিত হয়ে এক নব পরিচয় লাভ করেছে, তার কথা
তুলে ধরেছে। গ্রন্থটির শেষে একটি গ্রন্থ পরিচয় রয়েছে, এই বিষয়ে আগ্রহী পাঠকদের খুব
কাজে লাগতে পারে। বইটি লিখিত হয়েছে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ভাষায়, যা প্রাবন্ধিকের
মননশীল বীক্ষণকে পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধে হবে না।
এরপর
আসি বইটির ভিতরের কিছু কথাতে। এই বইটি যারা পড়বে, বাগদি জাতি সর্ম্পকে তাদের একটি
সম্যক ধারণা হবে বলে মনে করি। ড. বাগদি এই গ্রন্থটির মধ্য দিয়ে বাগদি জাতির যে
ইতিবৃত্ত, তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেছেন। ইতিহাসে বাগদি জাতির খোঁজে তিনি বেদ,
মনু, পুরাণ থেকে সর্বশেষ আদমসুমারি ২০১১ এর তথ্যকেও তুলে ধরেছেন। যেখান থেকে আমরা
খুব সহজেই জানতে পারি, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাগদিদের মোট জনসংখ্যা
২৭৪০৩৮৫। ইতিহাসের আদি থেকেই এই বাগদিরা প্রান্তিক হিসেবে পরিচিত। জীবনের তাগিদে
নানারকম পেশা তাদের বেছে নিতে হয়েছে। এই অবহেলিত সমাজ ও সাহিত্যে নানা ভাবে দেখা
যায় চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ণ কাব্যে এদের উপস্থিতি দেখিয়েছেন লেখক। বাংলা
লোকসাহিত্যের মধ্যে বাগদিদের বীরগাথা যেমন
উঠে এসেছে তেমনি বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে, দারিদ্র্যের সঙ্গে তাদের যে লড়াই তার
কথাও ফুটে উঠেছে। আধুনিক কথাসাহিত্যে বাগদিদের নানা প্রসঙ্গ তিনি তুলে ধরেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র,
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ,সমরেশ বসু, গুনময় মান্না, মহাশ্বেতা
দেবী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, মণি মুখোপাধ্যায়, অনিল ঘড়াই– এই
সমস্ত লেখকদের উপন্যাস ও ছোটগল্পে তিনি বাগদিদের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করেছেন। আধুনিক
কথাসাহিত্যের উনিশ ও বিশ শতকের ধারায় বাগদি জাতি কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, তা
এই গ্রন্থটি না পড়লে বোঝা যাবে না। সবমিলিয়ে বলা যায়, বাগদি সমাজ ও সাহিত্যে তাদের
রূপায়ন নিয়ে যাঁরা ভাবতে চান, এই গ্রন্থটি সেই সব পাঠকের জন্য মূল্যবান।
বাংলা সাহিত্যে বাগদি সমাজ: বিকাশচন্দ্র বাগদি
প্রচ্ছদ: চ ঞ্চল গুইন
প্রকাশক: স্বপন পানঃ ২০০ টাকা
(প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট ২০১৮)
সম্পাদককে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই এরকম একটি বইয়ের খবর জানানোর জন্য। বইটি অ অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। অনুরোধ, এইরূপ আরও বই এর সন্ধান দিন।
মুছুনBagdi jatee ke sobay eto gihrnaa koree kenoo
উত্তরমুছুন