আমি উদাসীনতা বেছে নিয়েছি। আমি উদাসীন। নরম বিছানায়
উদাসীন শুয়ে থাকা, বেশ আছি। খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি।
মোবাইলে SBI থেকে মাসের এক তারিখে, SMS পেলে ব্যাস নিশ্চিন্তি। নিশ্চিন্ত হয় আমার
রোজকার উদাসীনতা। চোখটা এসির ঠান্ডায় আলতো হয়ে বুঁজে আসে। কখন আলগোছে ঘুম আসে, নিশ্চিন্তির
ঘুম। ঘুম ঘুম চোখে, বেশ একটা সুখী সুখী, ভোগ-ভোগ, রোদচশমার সুখী গৃহকোন। হঠাৎ দেখি
শোয়ার ঘরের ছাদটা আকাশ হয়ে গেছে। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে ইতিহাস বই এর ফেলে আসা পাতাগুলো।
ঘরের মধ্যে হঠাৎ একি জ্বালাতন। ইতিহাসের পাতাগুলো দল বেঁধে খোলা ছাদের আকাশে কাগজের
তৈরি সেই ছোটবেলার
রকেটের মত এলোমেলো উড়ে আসছে। চিরকুটের মত লেখা কিছু অতীত ঐতিহাসিক সত্য, প্রশ্ন করছে
বর্তমানের আমিকে। কিন্তু আমি যে এখন উদাসীন। বিচ্ছিরি ইতিহাস বই এর কিসব অতীত। উফ্
ঘুমটা ভাঙিয়ে দেবে দেখছি। কি যন্ত্রণায় পড়লাম। যাঃ! ইতিহাসের পাতাগুলো দেখি মশা
হয়ে গেলো। এক ঝাঁক মশা! আমার ছাদহীন ঘরে বেশ বয়স্ক কিছু মশা ভিড় জমিয়েছিলো। ওরা
বলল ভয় নেই, ভয় নেই। আমরা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া নিয়ে আসিনি। আমরা তোমাকে কতগুলো গদ্য
গান শোনাবো। তারপর চলে যাব। শুরু হলো ওদের গান, আর তার সাথে ওদের তীর্যক প্রশ্ন!
বললো তোমায় রামায়ণের গল্প বলি শোনো। আমি ভুরু কুঁচকে
বললাম রাম রাবনের যুদ্ধ? সে তো জানি। একটা মশা বেশ জাঁকিয়ে বসে বললো, না গো না, জভালির
গল্পটা বলি। জানোতো, সীতার অগ্নি পরীক্ষার নির্দেশ কে নস্যাৎ করে দিয়ে জভালি রামকে
বলেছিলো 'মূঢ়!' যাইহোক অনেক অনুনয় বিনয়ের পর জভালি বললো ঠিক আছে আমি রামকে মূঢ়
বলবো না। তবে কয়েকটা কথা বলতে চাই। মন দিয়ে শোনো। 'এমন কোনো ধর্মীয় আচার নেই যা পরজন্মে
পুন্যি দেয়। আর পরজন্ম সেও কি আছে? আসলে ভগবানকে পূজো করার বাধ্যতামূলক নির্দেশ, তাকে
সন্তুষ্ট করার জন্য বলিদান, উপঢৌকন, পুরোহিত দ্বারা নির্ধারিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত,
সকলই শাস্ত্রের বিধি। আসলে কিছু বুদ্ধিমান ও চতুর লোকের মস্তিষ্ক প্রসুত অভীস্পা, মানুষের
ওপর খবরদারি করার ফরমান মাত্র। আমি মশার দিকে তাকালাম উদাস চোখে। তাকালাম আমার ছাদহীন
ঘরের আকাশের দিকে। কি জানি, রাতের আকাশে আমি ছোট্টো একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম
কিনা!
আবার সময় না দিয়েই বৃদ্ধা মশা বললো, বাবা আরেকটা
ছোট গল্প শোনাই! আমি অস্পষ্ট ভাবে হ্যাঁ-না মিশিয়ে কিছু বলার আগেই বলতে শুরু করলো,
বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার জৈন সাধুদের তীব্র শ্লেষে প্রশ্ন করছে-'কি হে! তোমরা তো দেখছি
আমায় গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করছো না! আমি বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার।'
জৈন সাধু আলেকজান্ডারের দিকে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে
বললো-'শোনো ভাই আলেকজান্ডার, তুমি যেটুকু জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছো সেইটুকুই তোমার।
তুমি বিনা কাজে অর্থহীন ভাবে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছো-
নিজের ঘর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। প্রান্তরের পর প্রান্তর দখল করছো। শোনো আমরা
সবাই মারা যাবো। তুমি ও! শিগগিরই। আর তুমি ততটুকু ই ভূখন্ড পাবে যতটুকু তোমাকে কবর
দিতে লাগবে। '
উফ্ কি তীব্র এই বৃদ্ধা মশার কাঁমড়! আমার আধো আধো
সুখ সুখ ঘুম ছাড়খাড় করে দিচ্ছে দেখি। বাবা এর থেকে তোরা ডেঙ্গু-টেঙ্গু বয়ে আনতিস,
তাও বুঝি ভালো ছিলো।
মশার দল- দল বেঁধে কবিবাবুর কবিতা পাঠ শুরু করলো-
'হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন, শক্, হুন দল, পাঠান মোগল, এক দেহে
হলো লীন।'
আমি চিৎকার করে বললাম- 'আমি বহুত্ববাদ, বিবিধতার
মাঝে ঐক্য, এগুলো ইস্কুলে পড়েছি, লিখেছি। তোমার কাছ থেকে নতুন করে জানতে শিখতে হবে
না। তোরা আমার নির্বাচিত উদাসীনতা কিছুতেই ভাঙ্গতে পারবি না। পারবি না। কিছুতেই পারবি
না।
আমার ভীরু চিৎকারের মাঝে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে
উঠলো ওরা 'মনে আছে! চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকের রূপান্তর? মনে পড়ে আকবরকে? মনে পড়ে
1857 সালের সিপাহী বিদ্রোহ? হিন্দু সেনাদের সামনে বৃদ্ধ ভঙ্গুর, বাহাদুর জাফরের নেতৃত্ব?
মনে পড়ে 1905 সালের, হিন্দু-মুসলমানের হাতে হাত ধরে প্রতিবাদ, সুতীব্র প্রতিবাদ।
'
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, মনে পড়ে, সব ইস্কুলের
বইয়ে রেখে এসেছি। আমি শুনতে চাই না তোদের এই জ্ঞানগর্ভ ভাষন, আতলামি। বন্ধ কর।
আমার উদাসীন ভোগ ভোগ ভরা ব্যাতিক্রমী জীবন দামী,
ভীষন দামী। আমি তাদের চিৎকার করে বললাম-
হট্টোগোল করবেন না- শুনুন!
চুপ করে চিৎকার গুলো শুনুন।
চিৎকার মানে? না মানে খুঁজবেন না।
বলছি তো - চিৎকারের মানে খুঁজবেন না।
উদাসীন থাকাটাই আপনার বোধ-
আচ্ছা, এটা কি কারো হুকুম? বক্তাই বা কে?
শ্রোতা- কারাই বা তারা!
বলছিনা! প্রশ্ন করবেন না ।
শুনুন - মন দিয়ে শুনুন।
সারি সারি মাথার মাঝে
সারিবদ্ধ হয়ে থেকে
হাত তুলে সন্মতি জানাবেন।
হট্টোগোল করবেন না,
চুপ করে চিৎকার গুলো শুনুন
কিন্তু হট্টোগোল করবেন না।
মশার দল নীরবে চলে গেল আমার ছাদহীন আকাশের পথ দিয়ে।
আমি আমার উদাসীনতায় ভরা কোলবালিশ জড়িয়ে আকাশ দেখছি -
শান্ত উদাসীন আকাশ - আমার ব্যাতিক্রমী
উদাসীনতায় ভরে থাকা আকাশ।
বেশ ভালো লেখা। ভাবনার অবকাশ আছে।
উত্তরমুছুন