থিয়েটার থেকে বলছিঃ উদয়শংকর মুখোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক গদ্য




নেই... চতুর্থ দেওয়াল নেই...

"আমি একটা ঘর চেয়েছিলাম....তিন দেওয়ালওয়ালা একটা ঘর... আশা ছিলো তার চতুর্থ দেওয়াল হবো আমি নিজে.....সে একটা সাজঘর... যেখানে ক্রেপ স্পিরিট গাম আর জিঙ্কের মদির গন্ধে আমি সাজবো... আমি আহ্লাদিত পোশাক পরে আর চোখে সুরমা টেনে কনসার্টের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করবো..."অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সওদাগরের নৌকার প্রসন্নর সেই অমোঘ উচ্চারণ.... মনে পড়ে???? আসলে আমাদের অনেকেরই চতুর্থ দেওয়াল নেই... নেই সাজঘর...নেই নীল আকাশ... মেঘ নেই এক টুকরো....নেই টুপটাপ বৃষ্টি....সবাই সাজঘরে রঙ মেখে বসে আছি...তৃতীয় ঘন্টার অপেক্ষায়...মঞ্চ তৈরি...আলোকছটা ছড়িয়ে পড়ছে... ঐ তো ডানদিকে...ঐ তো বামদিকে। আবহে বাজছে বাহারি সুর....প্রপরা ডাকছে। হাততালি দিয়ে হাসিকান্নার আহ্বান জানাচ্ছে দর্শক...কিন্তু একি??? বাম হাতটা পোষাকে যে ঢুকছেইনা। ছিঁড়ে যাচ্ছে সুতোরা। সংলাপ ভুলে গিয়ে বেরোচ্ছে খিস্তি। এগোচ্ছে না কোন পা। অভিনেতা বসে পড়ছে দর্শক আসনে......বেজে উঠছে তৃতীয় ঘন্টা...... অভিনেতাকে ঠেলে ফেলে দর্শক অবস্থান নিলো মঞ্চে.......নাটক শুরু হলো....."চতুর্থ দেওয়াল" মঞ্চে মঞ্চে অবস্থান নিচ্ছে ওরা...... অবস্থান। মঞ্চে উঠে ওরা বলছে.... অভিনেতাদের চতুর্থ দেওয়াল নেই.... যদিও কারো আছে তা কপাট আঁটা দরজা বসানো.....কোন জানালা নেই.... যার ফাঁক দিয়ে কান পাতলে শোনা যায়... ধামসা মাদলের মিঠে সুর.... দেখা যায় না অন্য দেওয়ালদের। কাঁটাতারে ঘেরা চতুর্থ দেওয়ালেরা ফিসফিস করে কথা বলে....আসলে ওরা অ্যাসাইলামে অবস্থান নিয়েছে...............ব্লাক বক্স....অ্যাসাইলাম...মঞ্চ.... থিয়েটার... অভিনেতারা..... আজ আমরা সবাই শাজাহান। দারা, সুজা, মোরাদ আমাদের চার পাশে। জাহানারা দাঁড়িয়ে আছে ঐ যে ডাউন রাইটের ঠিক কোণে। দিলদার আর ঔরঙজেব আপ লেফটে বসে লিখছে বুকঝিম অবিশ্বাসের চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্যর ইলাস্ট্রেশনে আবছা ছবি। জলরঙের। জাহানারার ডাউন রাইট ঘুরে যায় up left -এ। হঠাৎ এন্ট্রি নেয় চাণক্য। জাহানারার পিঠে আলতো ছোঁয়া দেয়.........সংলাপ বলে.... "এই তো আমার হারিয়ে যাওয়া কন্যা.... অন্ধ ভিক্ষুক কে চিৎকার করে বলে... " বলো কোথায় পেয়েছো এই কন্যাকে?? জাহানারা অবাক হয়ে তাকায়... দুর্গাদাস কে বলে... কেন বলো কেন একটা জাত তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে???? চোখে জল নিয়ে দুর্গাদাস জড়িয়ে ধরে জাহানারাকে... প্রেক্ষাগৃহের দর্শক চিৎকার করে বলে... কি হচ্ছে এসব???? ঔরঙজেব পোশাক খুলে ফেলে। যশবন্ত সিংহ এক দর্শককে বোঝাবার চেষ্টা করে....দর্শকদের চিৎকারের কোরাস আগুন ছড়ায়। আগুন। আগুনের সারেগামা ছুটে চলে পলাশির প্রান্তরে...যেখানে ছোরা হাতে ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করছে মহম্মদি বেগ....এক্কেবারে পাশটিতে দাঁড়িয়ে থাকে বেণীমাধব চাটুজ্যে। তার হাতে তলোয়ার। টিনের। তবে জলদকুমারের হাত ফাঁকা। ময়না সবজি ঝুড়ি হাতে বসুন্ধরার শাদা চুলে বিলি কাটে...যুদ্ধের ময়দানে ছুটে আসে প্রিয়নাথ.....দর্শক হাততালি দেয়। ময়না আয়েসি বিছানায় শুয়ে পড়ে খোলা যুদ্ধের মাঠে....হাই তোলে....আবার দর্শকদের কোরাস...."এমনটা তো হবার কথা ছিলো না? কাপ্তেনবাবু, এ সব কি খাওয়াচ্ছেন আমাদের? " কাপ্তেনবাবু বাংলার বোতল বগলদাবা করে লো স্কেলে কাঁদে... " আমি বাংলার গ্যারিক...তিল তিল করে তৈরি করেছি আমি ময়না কে... ময়না আমার তৈরি.... অন্য কোন থিয়েটারে অভিনয় করতে দেব না ময়নাকে....."দর্শকরা নড়ে বসে। কেউ কেউ ব্যালকনিতে অবস্থান নেয়। বেহেড মাতাল হয়ে কাপ্তেনবাবু ময়নাকে খিস্তি মারে, কাঁদে, আগুনমুখো অভিব্যক্তি ছড়িয়ে অট্টহাস্য করে চিৎকার করে উঠে বলে.... অভিনয় করে একমাত্র আঙুর বুঝলি মাগি... আর আমরা? জলে আঁক কাটি...তৃতীয় দেওয়ালে পরে ঘা....ঢং.. ঢং। ঘন্টার শব্দ মাটি ভেদ করে। ঐ তো চতুর্থ দেওয়াল.... ঐ তো....কাছে....আরো কাছে....ডানদিকের আসনের দর্শকরা চিৎকার করে... ফাজলামি হচ্ছে নাকি কাপ্তেনবাবু...? নষ্টামি করছেন? কাপ্তেনবাবু বলে ওঠেন... দেখতে পাচ্ছেন না আপনারা? ...৪৭এর ফ, ৩৯ এর ঙ রা কেমন বাহারি প্যান্টালুন পরে তৃতীয়
দেওয়ালে চুমু খাচ্ছে? এবার দর্শকরা আশ্বস্ত হয়....চুপটি করে বসে থাকে। ক্লাইমেক্স... অ্যান্টিক্লাইমেক্সে জমে ওঠে মঞ্চ.....ঘোর ঘোর লাগে। হ্যালুসিনেশন। কুয়াশায় ভরে যায় মঞ্চের ক্যানভাস। ঝুলছে ক্যানভাস। জালের আড়ালে। রঙ ভাসে। রং ভেদ করে উপরে উঠতে তো পারতো ৪৭ এর ফ রা?? এবার জিজ্ঞাসা করে কাপ্তেনবাবু.........কিহে দর্শকরা? আনবেন না ওদের? চুপ... দর্শকরা...একেবারে নিশ্চুপ...কথাহারা...মাথা নিচু ওদের.... নিচু...... কাপ্তেনবাবু হাসে.....তৃতীয় দেওয়ালে কান পেতে ঘুমিয়ে পরে.... বাংলা মদের বোতল থেকে একটু একটু করে চুইয়ে চুইয়ে নদীর মতো বয়ে চলে নেশাহীন মদ.....সেই মদে চুমুক দিয়ে প্রিয়নাথ মল্লিক জড়িয়ে ধরে তৃতীয় দেওয়ালকে.....খুঁজে চলে.... খুঁজেই চলে... চতুর্থ দেওয়াল.... এখন অনেক রাত..... দু নম্বর.... তিন নম্বর দেওয়ালেরা ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুম। গভীর। শুধু ঘুম নেই এক নম্বর দেওয়ালের চোখে। "ঘুম নেই" । ঘুম নেই। এক নম্বর দেওয়াল ছটফট করে। দু নম্বর দেওয়াল পাশে বসে। মাথায় হাত দেয়। ঘুমঘোর তিন নম্বর দেওয়াল কে ধাক্কা দেয়। নড়ে ওঠে শুধু একবার.....এক নম্বর দেওয়াল কি করবে বুঝতে পারে না। কি করবে?....কি করবে???? Down centre এ গিয়ে উঁকি দেয়........দেখে...সামনে যে অন্ধকার... কেউ কি নেই? আরো সামনে এগিয়ে যায়..... ঘুমিয়ে পড়েছে যে দর্শকরা..... এই যে শুনছেন???? উঠুন.......উঠুন.... উঠুন............ কেউ সাড়া দেয় না..........এক নম্বর দেওয়াল সাজঘরে যায়.....মাথার মুকুট খোলে.... পোশাক পাল্টায়..... ফিরে আসে মঞ্চে......আকাশ ফাটানো চিৎকার করে....উঠুন সবাই...উঠুন....উঠুন... উঠুন..... কেউ সাড়া দেয় না...মঞ্চ থেকে নেমে আসে দর্শকাসনে.....ডাকে বার বার...বার বার ডাকে...নিশ্চুপ প্রেক্ষাগৃহ.....নিস্তব্ধ....শীতল নিস্তব্ধতা...পিছন ফেরে...আস্তে....আস্তে.....দাঁঁড়ায় এসে মঞ্চে...middle centre-এ বলে ওঠে...."আমি একটা ঘর চেয়েছিলাম. তিন দেওয়ালওয়ালা একটা ঘর। আশা ছিলো তার চতুর্থ দেওয়াল হবো আমি নিজে... সে একটা সাজঘর...

৫টি মন্তব্য:

  1. আরো চাই এমন লেখা...

    উত্তরমুছুন
  2. আবেগপূর্ণ লেখা... ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন
  3. নাট্যকর্মী হিসেবে উদয়শঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে আমি বহুদিন ধরেই চিনি। আমার দেখা সেই সময় ও তার আগের সময়ের গল্পগুলো উঠে আসুক ওনার লেখায় এই কামনা করি। মঞ্চের বাইরের গল্প, সাজঘরের কাহিনি, একটা নাটকের নাটক হয়ে ওঠার লড়াইটা চাই।

    উত্তরমুছুন

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com